স্টাফ রিপোর্টার :
চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারের নিয়ন্ত্রণাধীন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসগুলোতে কর্মরত রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। সরকারি চাকরির বিধি অনুযায়ী তিন বছর অন্তর বদলির নিয়ম থাকলেও রহস্যজনক কারণে তিনি দীর্ঘদিন ধরে একই পদে বহাল আছেন। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ—উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তিনি বহাল তবিয়তে থেকে যাচ্ছেন।
দলিল জালিয়াতির অভিযোগ
নাগরিক নিউজের হাতে আসা কিছু দলিলের (নকল কপি) মধ্যে দেখা গেছে, হাটহাজারী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৪০ সালের নিলাম হওয়া দক্ষিণ পাহাড়তলী মৌজার একটি দলিলে অসঙ্গতি রয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছে, বালামের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও অঞ্জনা সেন নিজ হাতে ১৪৩ নং এস/সি দলিল লিখে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে একটি পক্ষকে সরবরাহ করেছেন।
এছাড়া বোয়ালখালী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ১৯৭৬ সালের ৬৩৩ নং দলিলের ক্ষেত্রেও দাগ-খতিয়ান পরিবর্তনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, ওই দলিলের নকল একবার সরবরাহ করা হলেও পরবর্তীতে কোনো নকল দেওয়া হয়নি।
ভুক্তভোগীর অভিযোগ
সম্প্রতি পাঁচলাইশ এলাকার সাইফুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি মহাপরিদর্শক নিবন্ধন, আইন মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৫২ সালের সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের ৫০৬৪ নং একটি জাল দলিল অঞ্জনা সেন নিজ হাতে তৈরি করে সাইফুল ইসলাম গংকে ভূমিহীন অবস্থায় ফেলে দেন। তার দাবি, “অঞ্জনা সেনের বিরুদ্ধে শত শত অভিযোগ করার পরও কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অপকর্ম
অভিযোগ রয়েছে, রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ সিন্ডিকেটে নকল নবিশ জয়দেব পাল, বিপ্লব সরকারসহ কয়েকজন নিয়মিত সহযোগিতা করছেন। তারা বালামে দাগ পরিবর্তন, ঘষামাজা, সূচি বইয়ের পাতা ছেঁড়া ও দলিলের পরিমাণ পরিবর্তনের মতো অনিয়মে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অফিস সূত্রে জানা গেছে, রেকর্ড রুমে এপ্রেনটিস হিসাবে কাজ করা অন্তত দশজনকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে অর্থায়ন করে নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন শাহজাহান, মান্নান, বশির, জাহাঙ্গীর, সাগর, সবুর, জামাল, তৌফিক, বিপ্লব ও সুধীর। সরকারি বেতন না পেলেও এদের পারিশ্রমিক বহন করেন অঞ্জনা সেন।
পূর্বের অনিয়ম ও অভিযোগ
অভিযোগকারীরা আরও জানান, ফটিকছড়ি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে ১৯৯৬ সালের একটি দলিলে রেকর্ড রুমের নকল নবিশ বাবুল কুমার দে জমির পরিমাণ পরিবর্তন করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন। কিন্তু পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ অভিযোগেও অঞ্জনার নাম উঠে এসেছে।
এছাড়া অতীতে একাধিকবার আদালতে পাঠানো বালাম বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনায় দায়িত্বে থাকা সাব-রেজিস্ট্রার অঞ্জনাকে দায়ী করে বরখাস্তের সুপারিশ করলেও পরবর্তীতে তিনি আবার বহাল হন।
প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে দীর্ঘদিন ধরে অঞ্জনা সেন নিজের প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রশাসনিক মহলের একটি অংশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা এবং মাসিক মাসোহারা দেওয়ার মাধ্যমেই তিনি এ অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগকারীদের দাবি।
অফিস সূত্রে আরও জানা যায়, রেকর্ড রুমে সিসি ক্যামেরা বসানো হলেও কৌশলে অঞ্জনা সেনের রুমে কোনো ক্যামেরা লাগানো হয়নি। ফলে তার কার্যকলাপের সঠিক নজরদারি হয় না।
তদন্তাধীন অভিযোগ
গত কয়েক বছরে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ আইন মন্ত্রণালয়, মহাপরিদর্শক নিবন্ধন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে পৌঁছালেও এখনও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তবে জানা গেছে, সাম্প্রতিক অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে পটিয়া সাব-রেজিস্ট্রারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
অঞ্জনার সম্পদ নিয়ে প্রশ্ন
অভিযোগকারীদের দাবি, অঞ্জনা সেন ব্যক্তিগত জীবনে সাধারণ জীবনযাপন করলেও তার নামে একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনৈতিকভাবে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযুক্তের বক্তব্য
অভিযোগের বিষয়ে জানতে রেকর্ড কিপার অঞ্জনা সেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
Leave a Reply