অঘোষিত শাকিল-সেলিম সাম্রাজ্য মাসে কোটি টাকার লেনদেন
এ ইউ মাসুদ, সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি:
৫ আগস্টের পর দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপট বদলাচ্ছে। কিন্তু যদি স্থানীয় রেজিস্ট্রি অফিসগুলো আগের মতোই থেকে যায়, তাহলে জনগণের পরিবর্তনের আশা অপূর্ণই থেকে যায়, এবং সেটাই ঘটছে সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে। দুর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত। এক পার্সেন্ট বানিজ্য থেকে কারো রেহাই নেই।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দীর্ঘদিন ধরে ১% ঘুষ বাণিজ্য একটি অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। শাকিল-সেলিম নামের দুই কর্মচারীর হাতে ঘুষ লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ, অফিসের অভ্যন্তরে বণ্টন, প্রভাবশালীদের মাসোহারা; সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে এক প্যারালাল প্রশাসন। কেউ যদি ১ কোটি টাকা মূল্যের একটি দলিল রেজিষ্ট্রেশন করেন, তবে তার কাছ থেকে রেজিষ্ট্রেশন অফিসে ১ লক্ষ টাকা নেয়া হয়; সেটা সাব-কবলা হউক, দান পত্র দলিল, হেবা দলিল, আমমোক্তারনামা দলিল কিংবা বায়নানামা দলিল। এসব দলিলে সরকার যথাক্রমে ৭.৫%, ৫.৫% ও ৭.৫% হারে রাজস্ব পায়। কিন্তু এর বাইরে অফিসের কর্মীরা মৌজা মূল্যের ১% ঘুষ আদায় করে থাকেন।
এই অফিসের দলিল লেখকদের মধ্যে প্রচলিত একটি অঘোষিত নিয়ম আছে – মৌজা মূল্যের ১% হারে ক্যাশ টাকা শাকিলের হাতে না দিলে দলিল রেজিস্ট্রি হবে না। একজন দলিল লেখক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়াকফ দলিল ছাড়া সব দলিলেই ১% হারে টাকা অফিসকে দিই। শাকিলের হাত দিয়ে সব লেনদেন হয়। এই টাকা না দিলে রেজিস্ট্রিতে নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়, ফলে দলিল ঝুলে যায়।” উপরন্তু খতিয়ান অনুযায়ী জমি যদি দোকান হিসেবে উল্লেখ থাকে, তাহলে রেজিস্ট্রেশন ফি বেশি হয়, এই অজুহাতে শাকিল নানাভাবে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঘুষ আদায়ের কেন্দ্রবিন্দু শাকিল-সেলিম, অফিসের অভ্যন্তরীণ সূত্র ও একাধিক দলিল লেখকের তথ্যমতে এই অবৈধ অর্থ লেনদেনের মূল হর্তাকর্তা হলেন অফিসের কর্মচারী শাকিল আর কেরানি সেলিম। শাকিল অফিসের কোনো স্থায়ী কর্মচারী নয়, তবু পুরো রেজিস্ট্রি কার্যক্রম তার হাতেই নিয়ন্ত্রিত। রেজিস্টির অফিসে তার দাপট এতটাই বেশি যে সে ছুটিতে থাকলে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম কার্যত বন্ধ থাকে। শাকিলের ‘সাম্রাজ্য অফিসের বাইরেও বিস্তৃত। স্থানীয় বাসিন্দাদের তথ্যমতে, শাকিল সাতকানিয়া পৌরসভা ও কেরানিহাট এলাকায় একাধিক প্রাইভেট হাসপাতাল ও দোকানপাটের মালিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ভুক্তভোগি জানান, “আমজনতা কোন দলিল রেজিষ্ট্রেশন করতে গেলে রেজিষ্ট্রেশন অফিসে তাদের চাহিদা মত শতকরা ১ ভাগ টাকা দিতে হয়, না দিতে চাইলে দলিলে দাড়ি, কমা, কার-ফলা, পর্যন্ত পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করে। কমপক্ষে ২৫/৩০ বার একটি দলিলের পৃষ্ঠা পরিবর্তন করায়। সর্বশেষ তাদের ইচ্ছা মত না হলে, কিংবা যেকোন অজুহাতে দলিল রেজিষ্ট্রেশন না করে ফেরত দিয়ে দেয়। এক কথায় চরম হয়রানি করে। তবে দলিল লেখকগনের ক্ষেত্রে ভিন্ন, কারন তারা রেজিষ্ট্রেশন অফিসে চাহিদা যথাযথ ভাবে পুরণ করে। ”
এঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় সাতকানিয়া আদালতের আইনজীবি মোহাম্মদ জনুনাইদের ফেসবুকে সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের হয়রানির ঘটনা শেয়ার করেন, তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
সাম্প্রতিক সময়ে আমি একটি হেবা দলিল রেজিষ্ট্রেশন করতে গিয়েছিলাম সাতকানিয়া সাব-রেজিষ্ট্রেশন অফিসে। দলিলের দাতাগন হিন্দু মহিলা, তাদের মধ্যে একজনের ছেলে আছে আরেকজনের ছেলে নাই। তারা দুইজনে ওয়ারিশ মুলে পৈত্রিক সম্পত্তি বি,এস নামজারী করেছে সমান সমান অংশে। পরবর্তীতে তারা দুইজনে উক্ত জমি তাদের ছেলে/ভাগিনাকে দান পত্র করতে চাই। বর্তমান সাতকানিয়া সাব-রেজিষ্ট্রার বলেন ওয়ারিশ মুলে নামজারী সঠিক হয়নি, এজন্য জমি হেবা করা যাবে না, তবে সাব- কবলা করা যাবে। আমার কথা হচ্ছে ওয়ারিশ মুলে নামজারী সঠিক না হলে সহকারী কমিশন ভুমি কিভাবে নামজারি দিয়েছে। নামজারী ভুল না কি শুদ্ধ এটা সাব- রেজিস্ট্রার দেখার বিষয় কিনা? নামজারি ভুল হলে উনি সাব- কবলা কেমনে রেজিষ্ট্রেশন করবে? উনাকে অনেক বুঝতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে চলে আসি। পরবর্তীতে শুনলাম কোন এক দলিল লেখকের মাধ্যমে সাব- রেজিস্ট্রারকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে দান পত্র রেজিষ্ট্রেশন করছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসে উৎসকর বাদে সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে ৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এর বাইরে ১% ঘুষ হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় কোটি টাকার বেশি নগদ লেনদেন হচ্ছে যার কোনো সরকারি রেকর্ড নেই। অফিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এইসব টাকা শাকিলের হাত দিয়ে আদায় হলেও বণ্টন হয় সাব-রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে। শাকিল শুধু ঘুষ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে। এজন্যই তার মাসিক ইনকাম ২ কোটি টাকার কাছাকাছি।”
এই ১ পার্সেন্ট জনগণের পকেট কাটা, রাজস্বের ক্ষতি, এই ১% ঘুষ প্রথার কারণে সাধারণ মানুষকে দলিলপ্রতি ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকার বেশি অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। এতে একদিকে জনগণের পকেটকাটা হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের বৈধ রাজস্ব হারাচ্ছে। অথচ এই পুরো প্রক্রিয়া চলে প্রকাশ্যেই—কিন্তু কার্যকর তদারকির অভাবে বছরের পর বছর কেউ এটি ভাঙতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসবের বিরুদ্ধে দলিল লিখক সমিতি, সাধারণ জনগণ বা ভুক্তভোগিরা প্রতিবাদ করেন না কেন! উত্তর সোজা- দলিল লিখকরা এতে লাভবান হোন, বাকি রইলো ভুক্তভোগি, তারা হয়রানির ভয়ে প্রতিবাদ করেন না। যে কোন কবলা রেজিষ্ট্রেশন করার ক্ষেত্রে দলিলের টাকার অংকের উপর প্রতি লক্ষে ৭৫০০ টাকা বা শতকরা হিসাবে ৭.৫০% সরকারকে রাজস্ব ফি দিতে হয়। কিন্তু দলিল লেখকগন দলিল গ্রহিতা কাছ থেকে জমির মূল্যের উপর প্রতিলক্ষে ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে নেন। দলিল লেখকরা যদি ৭৫০০ টাকা সরকারকে রাজস্ব দেন এবং ১০০০ টাকা করে রেজিষ্ট্রেশন অফিসে দেন, তবে তাদের পকেটে আরে প্রতি লক্ষে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত থাকে। যদি ১ কোটি টাকার দলিল হয় তবে সে টাকার অংক ২ লক্ষ থেকে ৩ লক্ষ টাকার কাছাকাছি একজন দলিল লেখক পায়। এইজন্য কোন দলিল লেখক রেজিষ্ট্রেশন অফিসের দূর্নীতির প্রতিবাদ করে না।
প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন হলেও নীরব প্রশাসন। ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে শাকিল এবং সেলিমের সাথে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। অ্ন্যদিকে সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রার টিনু চাকমাকেও একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল নম্বর সার্বক্ষণিক বিজি দেখায়, এরকমই অভিযোগ করেন সাতকানিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকগণ।
তবে চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামীলুর রহমান বলেন, “ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ আমরা প্রায়ই শুনি। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারও প্রভাবশালী পরিচয় দেখেও ছাড় দেওয়া হবে না।” তিনি আরও যোগ করেন, “লোকমুখে শুনে আমরা কিছু করতে পারি না, ভুক্তভোগীদের লিখিত অভিযোগ করতে হবে। তাহলেই আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারবো।”
সাতকানিয়া সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে গড়ে ওঠা ঘুষের রাজত্ব কেবল দুর্নীতির উদাহরণ নয়, এটি স্থানীয় প্রশাসনের ব্যর্থতারও প্রতিচ্ছবি। অভিযোগের পাহাড় থাকলেও কার্যকর তদন্ত বা প্রশাসনিক পদক্ষেপের অভাবে এই প্রথা এখন এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সাধারণ জনগণ এ থেকে পরিত্রাণ চায়।
Leave a Reply