কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) পেট্রোবাংলার আওতাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। চট্টগ্রাম নগর ও ১১টি উপজেলায় গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে রয়েছে কোম্পানিটি। এসব এলাকায় মোট গ্রাহক-সংযোগ রয়েছে ৬ লাখ ১ হাজার ৯১৪টি। এর মধ্যে গৃহস্থালি সংযোগ আছে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৫৬১টি, বাকিগুলো শিল্প-বাণিজ্যসহ অন্য খাতে।
কিন্তু চট্টগ্রামে গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা কেজিডিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়া এমডি সালাহ উদ্দীন ঘুষ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন তার শক্তিশালী সিন্ডিকেট নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছে। আইনকানুনের কোন বালাই নেই তার কাছে। টাকা ঢাললেই সবকিছু মেলে, রাতকে দিন আর দিনকে রাত বানাতে সিদ্ধহস্ত তিনি।
জানা যায়, সেবা প্রার্থীদের অনেকে কর্ণফুলী গ্যাসের অফিসে ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় করে ফেলেছেন তবুও সংযোগ পাননি। আবার ঘুষ ঢেলে একদিনেই সংযোগ পাওয়া যায় এমন দাবী করলেন সংশ্লিষ্টরা। কর্ণফুলী গ্যাস (কেজিডিসিএল) এ অনিয়ম-দুর্নীতি, ঘুষ বাণিজ্য এখন মহামারির মত ছড়িয়ে পড়েছে।
সংস্থাটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সালাহ উদ্দিন-এর বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রধান বরপুত্র হিসেবে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। যার কারণে তিনি ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুদক। এমডি তার প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে ঘুষ বাণিজ্যের পাশাপাশি একজন আওয়ামীলীগ নেতার ভাইকে নিয়ে গড়েছেন বিশাল গ্যাস চোর সিণ্ডিকেট। যারা গিলে খাচ্ছে কেজিডিসিএলকে।
এই সিন্ডিকেট সরকারি জমি-পাহাড়েও মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে গ্যাস সংযোগ দিচ্ছে এমন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের অবৈধ সংযোগ পরিবেশগত ও ভূমি আইন লঙ্ঘন করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের রাজস্বেও ব্যাপক ক্ষতি করছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে কেজিডিসিএলে গ্রাহকের চাহিদার বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় প্রায় ২৪২.৫ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে অভিযোগ উঠেছে যে, এই সরবরাহ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না এবং এর প্রায় অর্ধেক গ্যাস চুরি হচ্ছে নগরীর বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাসা-বাড়িতে। এর কিছু অংশ অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাধ্যমে চুরি হিসেবে দেখানো হলেও, বাকি বিশাল অংশ দেখানো হচ্ছে সিস্টেম লস হিসেবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এই অস্বাভাবিক উচ্চ সিস্টেম লস মূলত গ্যাস চুরিরই নামান্তর, যার মাধ্যমে চক্রটি কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হরিলুট করছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্যাতিত ও পদোন্নতি বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কর্মবঞ্চিত ঠিকাদার শ্রেণির একটি অংশের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তাদের মতে, গত বছর ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও কেজিডিসিএলে স্ব-স্ব পদে বহাল রয়েছেন আওয়ামী দোসররা। যারা আগে বীরদর্পে অনিয়ম দুর্নীতি করে গেলেও থেমে নেই বর্তমানেও। তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি দুর্দান্ত গতিতে চলছেই। দিন দিন তাদের প্রভাব আগের মতো বিস্তার লাভ করছে।
তারা জানান, কেজিডিসিএলের এমডি মো. সালাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে এই চক্রের অন্যতম হলেন ডেপুটি ম্যানেজারের (পিআরও) বেলাল উদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম-১০ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত এমপি ও চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মহিউদ্দিন বাচ্চুর ছোট ভাই বলে সূত্রের দাবি।
তথ্যমতে জানা যায়, সম্প্রতি চট্টগ্রাম-হাটহাজারী সড়কের অক্সিজেন জালালাবাদ এলাকায় ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার নামে একটি কারখানায় ধরা পড়ে গ্যাস চুরির জালিয়াতি। প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছর আগে গ্যাস সংযোগে ৯৪ কেজি বয়লার লাগানোর অনুমতি পান কেজিডিএিসএল থেকে। কাজ পায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান শাওন এন্টারপ্রাইজ। কিন্তু সেখানে গোপন চুক্তির মাধ্যমে লাগানো হয় ২৫০ কেজির বয়লার। যা ব্যবহারে আড়াইগুণ বেশি গ্যাস চুরি হয়।
নিটওয়্যার কারখানার সংশ্লিষ্টরা জানান, ২৫০ কেজির বয়লার বসিয়ে দ্বিগুণ অর্থ হাতিয়ে নেয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। যার সাথে যোগসাজশের মূলে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন ব্যবস্থাপক বেলাল উদ্দিন। তবে গত আগস্ট মাসে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টি ধরা পড়লে কারখানাটির গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় কেজিডিসিএল। পরে ৯৪ কেজি বয়লারের স্থলে ফের ১০০ কেজির বয়লার বসানো হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার কারখানার মালিক মো. ফয়সাল বলেন, বয়লারের ধারণক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। জরিমানা দিয়ে সমস্যাটি সমাধান করেছি। এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না। বললে সমস্যা বাড়বে।
সূত্র আরও জানায়, সম্প্রতি শাওন এন্টারপ্রাইজের নামে পতেঙ্গায় বিপিসি নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারীর সি এম এস আভ্যন্তরীণ গ্যাস লাইনের জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ কাজে আর এফ কিউর মাধ্যমে ১৮ লাখ টাকার কার্যাদেশ বিনা টেন্ডারে দেওয়া হয়। অথচ এ পদ্ধতিতে ৬ লাখ টাকার বেশি কার্যাদেশ দেওয়ার নিয়মই নেই। এর মধ্যে রয়েছে আরও বড় ধরনের কারচুপি ও সরকারি অর্থ লোপাটের ঘটনা।
সেটি হলো, কার্যাদেশ বাস্তবায়ন শেষে ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে নেওয়া সমাপ্তি প্রত্যয়নে ৮২ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। যা পুরো তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর এই কারচুপিতে জড়িত ইস্টার্ন রিফাইনারির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কেজিডিসিএলের এমডি’র চোরাই সিন্ডিকেট।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রামে হাজার হাজার শিল্প কারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসা-বাড়িতে গ্যাস সংযোগ রয়েছে। আর এই গ্যাস সংযোগ নিতে চলে নানা কারচুপি ও অনিয়ম। যার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু গ্যাস সংযোগ দিয়ে থেমে নেই। প্রতি সংযোগকে যেন অবৈধ আয়ের মেশিন বানানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, যেমন কোনো শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে গ্যাস ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বয়লার বসাতে হয়। কিন্তু গ্যাস সংযোগের সময় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়লার বসিয়ে দেয়। এতে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহার করলেও সরকার পায় অনুমোদিত বয়লারের মাত্রার বিল। বাকি বিল ঢুকে ঠিকাদার থেকে বিল শাখা, ডিজিএম মার্কেটিং ও ডিজিএম ভিজিলেন্স কর্মকর্তার পকেটে। আর সব টাকা বিলি হয় পিআরও বেলাল উদ্দিনের হাত দিয়ে।
কারণ—পদাধিকার বলে না হলেও অস্ত্র ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে কেজিডিসিএলের অঘোষিত এমডি এই বেলাল উদ্দিন। যা আজও বহাল রয়েছে। নামে-বেনামে তার একাধিক ঠিকাদারি লাইসেন্সও রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বেলাল উদ্দিনের মাধ্যমে অবৈধ আয়ের কোটি টাকা প্রতি মাসে কেজিডিসিএলের বর্তমান এমডি সালাহ উদ্দিনের পকেটের ঢুকে। ফলে মুখে কুলুপ দিয়ে রাখেন এমডি সালাহ উদ্দিন। প্রতিষ্ঠানের সবাই জানে বেলাল উদ্দিন এমডি সালাহ উদ্দিনের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। ফলে ভয়ে থাকেন প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী।
যার প্রমাণ দিতে কেজিডিসিএল থেকে প্রকাশিত একটি সাময়িকী প্রকাশের ঘটনা সামনে নিয়ে আসেন ক্ষিপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেটা হলো, সর্বশেষ সাময়িকী প্রকাশের জন্য বিজ্ঞাপণের কথা বলে ৩০ লাখ টাকা হাতিয়েছেন বেলাল উদ্দিন। এরমধ্যে খোদ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য তিন লাখ টাকা দাবি করেন বেলাল। এত টাকা না দেওয়ায় বেলাল উদ্দিন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সাথেও উদ্যত্তপূর্ণ আচরণ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বেলাল উদ্দিনকে ‘বেয়াদব’ আখ্যা দিয়ে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে কেজিডিসিএলের এমডি বরাবরে চিঠি লিখেন। কিন্তু এমডি সালাহ উদ্দিন কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো বেলাল উদ্দিনের বিষয়টি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানিয়ে উত্তরপত্র পাঠান।
শুধু তাই নয়, সার্ভিস রুল অনুযায়ী, সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ জেলার ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে পোস্টিং বা বদলি না হওয়ার নিয়ম না থাকলেও আওয়ামী ক্ষমতাবলে বাড়ির আধা কিলোমিটারের মধ্যে শুরু থেকে চাকরি করে যাচ্ছেন কেজিডিসিএলে। যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
কেজিডিসিএলের ভুক্তভোগী কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, বেলাল উদ্দিন এমন একজন লোক, যার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায় কেজিডিসিএলের অনেক কর্মকর্তা বিভিন্ন সময়ে চর-থাপ্পড় খেয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন অনেকেই। তার সাথে ৫৭ জন কর্মকর্তা সহকারী ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পেলেও এদের কেউ ডিজিএম হননি। সহকারী থেকে কোনোমতে ম্যানেজার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন।
যাদের কাছ থেকে কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন বেলাল উদ্দিন। ঘুষের অংশ থেকে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে ডিজিএম পদে পদোন্নতি নিয়েছেন তিনি। আর সাংবাদিকদের দুর্নীতিবাজদের অপকর্মের অনুসন্ধান থেকে সব রকমের অনিয়ম ও দুনীতি আড়াল করতে বেলাল উদ্দিনকে জনসংযোগ ও সমন্বয়ক ডিপার্টমেন্টের (পিআরও) দায়িত্ব দিয়েছেন বর্তমান এমডি সালাহ উদ্দিন।
কেজিডিসিএলের জনসংযোগ ও সমন্বয়ক ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি ম্যানেজার (ডিজিএম) বেলাল উদ্দিনের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে কেজিডিসিএলের এমডি সালাহ উদ্দিনের ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি তার কোনো জবাব দেননি। তবে তিনি জনসংযোগ ও সমন্বয়ক ডিপার্টমেন্টের সহকারী কুতুবুর রহমানের মাধ্যমে নিউজ আটকানোর চেষ্টা করেন।
সূত্র জানায়—এই কুতুবুর রহমানের মাধ্যমে এমডি সালাহ উদ্দিন ও তার সিন্ডিকেটের কুকর্ম, অনিয়ম দুর্নীতি, ঘুষ লেনদেন করে থাকেন, এবং ঘুষের একটি অংশ কুতুব উদ্দিনকে দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্টদের দাবী— কেডিসিএলের এই চক্রের মূল হোতা হিসেবে অভিযুক্ত এমডি সালাহ উদ্দিন এবং তার সিন্ডিকেটে জড়িত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এর মাধ্যমে দ্রুত তদন্তের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।