দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে পাসপোর্ট অধিদফতর। এরইমধ্যে সংস্থাটির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন অধিদফতরের উত্তরার ই-পাসপোর্ট পার্সোনালাইজেশন কমপ্লেক্স শাখার উপ-পরিচালক মাসুম হাসান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাসপোর্ট অধিদফতরে মাসুমের মতো অন্তত ৩০ জন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আছেন। তাদের বিরুদ্ধে অধিদফতরের ‘অ্যাকশন’ শুরু হয়ে গেছে।
পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল আনোয়ার বলেন, অধিদফতরের মহাপরিচালক পদে যোগদানের পর থেকে বলেছিলাম দুর্নীতি ও শৃঙ্খলা নিরসনে সচেষ্ট থাকবো। তদনুসারে কাজও করে আসছি। অধিদফতরকে দুর্নীতি ও শৃঙ্খলা মুক্ত করতে আমার যে কোনও প্রচেষ্টা বাস্তবায়নে শুরু থেকে অধিদফতরের ভেতর ও বাইরে থেকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
তিনি বলেন, যেহেতু আমি নীতিগতভাবে অন্যায়কারী ও দুর্নীতিবাজদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী নই। অন্যায়কারী সে যেই হোক তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আসতেই হবে। অধিদফতরের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে মামলা হয়েছে কিংবা বিভাগীয় তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণ হয়েছে; তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেবো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ৫ ডিসেম্বর গ্রেফতার হন উপ-পরিচালক মাসুম হাসান। অধিদফতরের করা এক মামলায় তাকে গ্রেফতার করে তুরাগ থানা পুলিশ। অধিদফতরের আলোচিত এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি গণমাধ্যম সম্প্রতি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে। মূলত এ প্রতিবেদনের পরপরই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তার বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় সাবেক সরকারের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে একে তো দুর্নীতি করেছেন তার সঙ্গে নিজের ইচ্ছেমতো পাসপোর্ট বানিয়েছেন। জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিকও তিনি। তার পরিবার আমেরিকায় থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, মূলত আমেরিকা যাওয়া আসার সুবিধার জন্য তিনি জাল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে একাধিক পাসপোর্ট করেছেন। সর্বশেষ বর্তমান সরকারের আমলে বিষয়গুলো তদন্তে প্রমাণ হওয়ার পর অধিদফতর থেকে মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
অধিদফতরের কর্মকর্তারাই বলছেন, পাসপোর্ট অধিদফতরের বিভিন্ন ইউনিটে মাসুম হাসানের মতো অন্তত ৩০ জনেরও বেশি দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আছে। বিগত সরকারের সময়েই তারা শীর্ষ দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত। ওই সময়েই তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলাও হয়েছে, যেসব মামলার তদন্ত চলমান। আবার কারও কারও বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে। সেসব তদন্তে অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। কিন্তু অভিযুক্তদের অনৈতিক প্রভাবের কারণে ব্যবস্থা নিতে পারেনি অধিদফতর।
এদের মধ্যে অন্যতমরা হলেন, পাসপোর্ট অধিদফতরের সিলেট বিভাগীয় অফিসের পরিচালক আলোচিত আব্দুল্লাহ আল মামুন, পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক (ডাটা অ্যান্ড পার্সোনালাইজেশন সেন্টার) তৌফিকুল ইসলাম খান, চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক সাইদুল ইসলাম, রংপুর পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক ওয়ালিউল্লাহ, বরিশাল পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক জাকির হোসেন, পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) শিহাব উদ্দিন খান, উপ-পরিচালক (অর্থ ও নিরীক্ষা) বিপ্লব কুমার গোস্বামীও উপ-পরিচালক মহের উদ্দিন শেখ প্রমুখ।
অধিদফতরের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, এই কর্মকর্তারা চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ। তারা যখন যেখানে কর্মরত ছিলেন, সেখানেই তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পত্র-পত্রিকায় তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছে। এতকিছুর পরও অধিদফতরের নির্দেশনার কোনও তোয়াক্কা করেননি তারা। এমনকি মহাপরিচালকের নির্দেশনাও পদে পদে লঙ্ঘন করতেন তারা।
এসব অভিযোগ জানালেও নাম প্রকাশ করতে চাননি কেউই। তারা বলছেন, আলোচিত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন আগের সরকারের আমলে কেমন প্রভাবশালী ছিলেন, তার নজির পাবেন একটি ঘটনায়। তিনি অধিদফতরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভাতেই এক অতিরিক্ত মহাপরিচালককে লাঞ্ছিত করেন। এমনকি এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে তিনি তার ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে মারারও হুমকি দেন। ওই সভাতে মহাপরিচালক নিজেও উপস্থিত ছিলেন।
এই ঘটনায় আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে গিয়েও ব্যর্থ হন কর্মকর্তারা। এরপর তাকে চাকরিচ্যুতির আবেদনও করা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাকে শুধু সিলেটে বদলি করা হয়। অভিযুক্ত এই মামুনকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি করেন তারা।
তৎকালীন সময়ে দুর্নীতিবাজসহ যারা বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত তারা এখনও বহাল তবিয়তে রয়েছে। তবে মাসুম হাসান গ্রেফতারের পর কর্মকর্তারা বলছেন, অধিদফতরের এমন কঠোর পদক্ষেপে অন্যান্য কর্মকর্তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আর যারা অভিযুক্ত তাদের এক প্রকার আতঙ্ক শুরু হয়েছে।
অধিদফতরের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অধিদফতর থেকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে আগের সরকারের আমলে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। দ্রুত আরও অনেককেই আইনের আওতায় আনতে কাজ শুরু হয়েছে।
Leave a Reply