ইমন দাশঃ
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান, যা বর্তমানে বাংলাদেশ, একের পর এক আর্থিক বৈষম্যের শিকার হয়। পাকিস্তানের শাসনকাল ছিল একটি নিপীড়নমূলক অধ্যায়, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শক্তি এবং সম্পদকে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহার করা হয়। রপ্তানি আয়ের লুটপাট, বাজেট বৈষম্য, সামরিক খাতে অতিরিক্ত ব্যয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ধ্বংসযজ্ঞ এসব কিছু মিলে পূর্ব পাকিস্তানের আর্থিক অবস্থাকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি পূর্ব পাকিস্তানকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করে। পাট এবং পাটজাত পণ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি পণ্য। বিশ্বব্যাপী পাটের বিপুল চাহিদা থাকায় এই খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতো। কিন্তু ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে এই রপ্তানি আয়ের প্রায় ৫৫% পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়। এই অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি, লাহোর, এবং ইসলামাবাদের মতো শহরগুলিতে শিল্প ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যবহার করা হয়।
বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬%, কিন্তু বাজেট বরাদ্দ পেত মাত্র ২৫%। স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অবকাঠামো খাতে এই বৈষম্যের প্রভাব গভীরভাবে অনুভূত হতো। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উন্নত সড়ক ব্যবস্থা এবং শিল্প নগরী গড়ে তোলা হলেও, পূর্ব পাকিস্তানে এসব খাতে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর এবং ঢাকার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানের উন্নয়ন অবহেলিত ছিল।
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করতেও ব্যবহৃত হতো। পাকিস্তানের সামরিক বাজেটের প্রায় ৭৫% ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের সুরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনী কার্যত কোনো ভূমিকা পালন করত না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর এই দীর্ঘ বৈষম্য এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়া ছিল। যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তাণ্ডবে বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধকালীন ধ্বংসযজ্ঞে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নষ্ট হয়। সরকারি ও বেসরকারি অবকাঠামো, কৃষি, এবং শিল্পখাতে এই ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল।
অন্যদিকে, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পরে আন্তর্জাতিক সহায়তা হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থও পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তর করা হয়। এই অর্থের অপব্যবহার পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য এক ন্যায়সংগত সহায়তা থেকেও বঞ্চিত হওয়ার উদাহরণ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নারী ও শিশুদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল, তা মানব ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। ২ লক্ষাধিক নারী পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত হন। এই ঘটনার আর্থিক এবং সামাজিক প্রভাব আজও বাংলাদেশের সমাজে বিদ্যমান।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষতিপূরণের দাবি উত্থাপন করেন। তিনি প্রায় ৪০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন, যা বর্তমান বিনিময় হার এবং মুদ্রাস্ফীতির ভিত্তিতে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার সমান। অর্থনীতিবিদদের মতে, শুধুমাত্র রপ্তানি আয়ের শোষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের ক্ষতির আর্থিক মূল্যায়ন আজকের দিনে প্রায় ১০ লাখ কোটি টাকার সমান।
পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা আদায়ের বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং ন্যায়বিচারেরও প্রশ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানির ক্ষতিপূরণ প্রদান কিংবা ইরাকে মার্কিন হামলার পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের আর্থিক সহায়তা এই উদাহরণগুলো বাংলাদেশের জন্য পথপ্রদর্শক হতে পারে।
যেমন জাতিসংঘের নীতিমালা এবং যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণ
জাতিসংঘের চুক্তি এবং বিভিন্ন মানবাধিকার নীতিমালায় যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সুস্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী নির্যাতন, এবং গণহত্যা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় বিচারযোগ্য।
আন্তর্জাতিক আদালতে (International Court of Justice) যুদ্ধকালীন ক্ষতিপূরণ দাবি করা যেতে পারে। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের এই পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার রয়েছে।তাছাড়াও পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপন করে ক্ষতিপূরণের দাবি আদায় সম্ভব।
উদাহরণ১ : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে বিভিন্ন দেশ এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ইসরায়েলের জন্য ক্ষতিপূরণের অর্থায়ন এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে পুনর্গঠন তহবিল তৈরি করা হয়।
উদাহরণ২: ইরাকের ক্ষতিপূরণ কুয়েত আক্রমণের পরে ইরাককে জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
এখন সময় এসেছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এই দাবি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো জোরালোভাবে উত্থাপন করার। জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে। দক্ষ কূটনৈতিক উদ্যোগ এবং আন্তর্জাতিক মিত্রদের সহায়তায় পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব।
পাকিস্তান থেকে পাওনা আদায়ের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং নৈতিক লড়াই। এটি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি একটি ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি। সময় এসেছে পাঁচ দশকের এই বৈষম্যের হিসাব বুঝে নেওয়ার।
Leave a Reply