আ ন ম সানাউল্লাহ -চট্টগ্রাম : সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের দক্ষতার কারণে অর্থনীতিতে চট্টগ্রাম বন্দরে ভুমিকা বিশ্বজুড়ে যেমন সমাদৃত ঠিক তেমনি আমদানি-রপ্তানীর খরচ অনেকাংশে কমে যাওয়ার কারণে যার সুফল ভোগ করছেন দেশের সাধারণ মানুষ। কমেছে পন্যের দামও।
দক্ষতার সাথে এমপিবি (মাল্টি পারপাস বার্থ) বর্তমানে সিসিটি (চিটাগং কন্টেইনার টার্মিনাল) পরিচালনার কারণে বন্দরের ‘প্রাণ‘ হিসেবে পরিচিত সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডে। যে বন্দরে ২০০৭ সালের আগে জাহাজের গড় অবস্থান ছিল ১০ থেকে ১২ দিন; সাইফ পাওয়ারটেক টার্মিনাল অপারেটর হিসিবে দায়িত্ব পাওয়ার পর জাহাজের গড় অবস্থান নেমে দাঁড়ায় দুই থেকে আড়াই দিনে। তারই ধারাবাহিকতায় সাইফ পাওয়ারটেক ২০০৭ সাল হতে এপ্রিল ২০২৪ সাল পর্যন্ত হ্যান্ডলিং করেছে ১৩হাজার ৭৩০টি জাহাজ। তারমধ্যে শুধুমাত্র এনসিটিতে হ্যান্ডলিং করেছে ৮হাজার ২৫১টি। ২০০৭ সাল থেকে জুলাই ২০২৪ সাল পর্যন্ত কন্টেইনার হ্যান্ডলিং (শুধুমাত্র ডিসচার্জিং ও লোডিং হিসাব অনুযায়ী) করেছে- ২কোটি ১০হাজার ২৯৬ টিইইউএস। যারমধ্যে এনসিটিতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ১কোটি ১৪লাখ ৪৩হাজার ৭৩৯টিইইউএস।
চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাপ্ত সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রতিবেশী দেশের বন্দরগুলোর ন্যায় প্রতিযোগিতামূলক ব্যয়ে জাহাজ থেকে কন্টেইনার দ্রুততার সাথে হ্যান্ডলিং করা ও তার সাথে এতদঅঞ্চলে একটি অন্যতম আধুনিক বন্দরে উন্নীত করতে এবং চট্টগাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এর উৎপাদনশীলতা জাহাজের নিজস্ব ক্রেনের চেয়ে ২-৩ গুন হ্যান্ডলিং বৃদ্ধি করার লক্ষ নিয়ে চট্টগাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) এমপিবি (মাল্টি পারপাস বার্থ) বর্তমানে সিসিটি (চিটাগং কন্টেইনার টার্মিনাল)তে মিতসুবিসি ব্রান্ডের ৪ টি রেল মাউটেন্ট কী গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি) সংগ্রহ করে।
৪টি রেল মাউটেন্ট কী গ্যান্ট্রি ক্রেন (কিউজিসি) এর সরবরাহকারী মেসার্স সুমিতমো কর্পোরেশন, জাপান এর লোকাল সার্ভিস সাপ্লাইয়ার সাইফ পাওয়ারটেক লি. ৩ বছর পর্যন্ত খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহসহ এগুলোর সংরক্ষণ, মেরামত ও পরিচালনার দায়িত্বে পালন করেছিলো। যা ২০০৬ সালের ৩০ জানুয়ারি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চালু করে চট্টগ্রাম বন্দর।
সেই সময় উক্ত ক্রেনগুলো চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের(চবক) নিজস্ব অপারেটর মাধ্যমে পরিচালিত হতো। কথিত আছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অনবিজ্ঞ অপারেটরের কারণে উক্ত ৪ টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের গড় কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ঘন্টায় ১০ থেকে ১১টির বেশি হতো না। যা ক্রেন সমূহের নুন্যতম হ্যান্ডলিং ক্ষমতার প্রায় এক তৃতীয়াংশ।
যার ফলে এমপিবি (মাল্টি পারপাস বার্থ) বর্তমানে সিসিটি (চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল) উৎপাদনশীলতা কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম হতো। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর জাতীয় ও আন্তজার্তিক গণমাধ্যেমগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সাইফ পাওয়ারটেক শ্রমিক সংগঠন এবং অদক্ষ অপারেটরগন বন্দরে সময়ে অসময়ে অযথা ধর্মঘট ডেকে বসত। ইক্যুইপমেন্ট অপারেটর সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের যোগসাজশে হয়রানির চিত্র ছিলো নিত্য দিনের। যার কারণে এতে করে আমদানীকারকরা সময়মতো তাদের পণ্য ডেলিভারী নিতে পারতো না। ফলে তাদের আমদানি ভোগ্য পণ্যের দাম স্থানীয় বাজারে বেড়ে যেত।
দেশি-বিদেশী শিল্প মালিকরা আমদানীকৃত কাচাঁমাল সরবরাহ সময় মত পেত না। ২০০৭ সালের পূর্ববতী সময়ে জাহাজর গড় অবস্থান ছিল ১০-১২ দিন। জাহাজের গড় অবস্থান বেড়ে যাওয়ার ফলে অপারেশনাল খরচ ছিল দ্বিগুন। যার ফলশ্রুতিতে জাহাজের বিদেশী মালিকগণকে গুনতে হতো অতিরিক্ত মাশুল। এবং বর্হিবিশ্বে বিরুপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছিল। এরই ফলে, জাহাজের বিদেশী মালিকগন চট্টগ্রাম বন্দর হতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন।
এখানে আরও উল্লেখ যে, প্রতি জাহাজের লোডিং আনলোডিং এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় করতে হতো যা পরবর্তীতে জাহাজের মালিককে বহন করতে হতো। এছাড়া, সেই সময়ে চট্টগাম বন্দরে জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামানোর পর সেই কন্টেইনার খুঁজে পেতে আমদানীকারককে অনেক সময় ও অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় করতে হতো, যার ফলশ্রুতিতে বন্দরে কন্টেইনার জটের সৃষ্টি হতো।
বন্দরের নানান সূত্র থেকে জানা গেছে, সেই সময়ে কন্টেইনারের গড় অবস্থান ছিল ২৫-২৬ দিন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি কন্টেইনার ইয়ার্ড হতে ডেলিভারী পয়েন্টে বসানোর জন্য সরকারী মাসুল ব্যাতিত অতিরিক্ত অর্থ ব্যায় করতে হতো। যা একটি সংঘবদ্ধ দল হাতিয়ে নিতো।
যার ফলশ্রুতিতে কন্টেইনার প্রতি ১৫০ থেকে ২০০ ডলার অতিরিক্ত সারচার্জ দিতে হতো। যার ফলে ব্যবসা-বানিজ্যেকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং আমদানীকারক সেই আর্থিক ক্ষতি পোষাতে তার আনীত পণ্যের উপর অতিরিক্ত অর্থ ধার্য্য করতে বাধ্য হতো এবং পণ্যের দাম অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পেত, যা সাধারন জনসাধারনের হাতের নাগালের বাহিরে চলে যেত। এতে করে শিপিং এজেন্টগন সিসিটিতে জাহাজ ভীড়াতে অপারগতা প্রকাশ করতো।
চট্টগাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) অপারেটর কর্তৃক পরিচালিত কী গ্যান্ট্রী ক্রেন দ্বারা আশানুরূপ উৎপাদনশীলতা অর্জিত না হওয়ায় তৎকালীন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে প্রাইভেট অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগ নেয়া হয়। এমতাবস্থায়, ২০০৬ সালে কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তৎকালীন মাননীয় মন্ত্রী, নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সভাপতিত্বে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) এর কর্মকর্তাবৃন্দগন, সিবিএ নেতৃবৃন্দগন, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ এবং বন্দর ব্যবহারকারীগণ একটি সভা করেন।
বন্দর সূত্র জানায়, সভার পরিপ্রেক্ষিতে সিসিটিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়। যার মধ্যে এমপিবি (মাল্টি পারপাস বার্থ) বর্তমানে সিসিটি (চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল) দক্ষ অপারেটর দ্ধারা কী গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে।যেহেতু কী গ্যান্ট্রি ক্রেন গুলোর সংরক্ষণ, মেরামত ও পরিচালনার দায়িত্বে সাইফ পাওয়ারটেক লি. নিয়োজিত। সুতরাং উক্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক দক্ষ ও অভিজ্ঞ কী গ্যান্ট্রি ক্রেন অপারেটর দ্ধারা কন্টেইনার হ্যান্ডলিং অপারেশান করা যেতে পারে। এছাড়া, উক্ত প্রতিষ্ঠান ব্যতিত অন্য প্রতিষ্ঠান অপারেশান এর দায়িত্ব পেলে সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি হতে পারে এবং কী গ্যান্ট্রি ক্রেনের উৎপাদনশীলতার কর্মকান্ড বিঘ্নিত হতে পারে। এইসব বিষয় পর্যালোচনা করে, সিপিটিইউ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের মতামতের ভিত্তিতে চট্টগাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (চবক) এমপিবি (মাল্টি পারপাস বার্থ) বর্তমানে সিসিটি (চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল) স্থাপিত কী গ্যান্ট্রি ক্রেন দ্ধারা কন্টেইনার হ্যান্ডলিং অপারেশান এর জন্য পিপিআর অনুযায়ী দরপত্রের কার্যক্রম শুরু করে।
পরবর্তীতে সরকারী অনুমোদন সাপেক্ষে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সাথে চুক্তি সম্পাদন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমের মাধ্যমে ২০০৬ সালের ৪ অক্টোবর থেকে দক্ষ বিদেশী অপারেটর দ্ধারা ৪টি গ্যান্ট্রি ক্রেন দ্ধারা কন্টেইনার হ্যান্ডলিং অপারেশান কাজ শুরু করে সাইফ পাওয়ারটেক ।
বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে সাইফ পাওয়ার টেকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, বর্তমানে একটা গোষ্ঠী চট্টগ্রাম বন্দর এবং সাইফ পাওয়ার টেককে নিয়ে অযাচিত মন্তব্য করে যাচ্ছে যা আসলেই মোটেও সঠিক নয়। আপনারা গণমাধ্যম গুলোই ভালোবাবে অবগত আছেন এ পর্যন্ত সাইফ পাওয়ার টেক তাদের প্রত্যেকটি কাজ সুনামের সাথে সম্পাদন করেছে।তারপরেও অনেকেই চট্টগ্রাম বন্দরকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এ রকম তির্যক মন্তব্য করে যাচ্ছে যা আসলেই কাম্য নয়।
জানতে চাইলে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমীন বলেন, প্রতিযোতীয়তামূলক দরপত্রের মাধ্যমে বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডিলিং কাজ করার সুযোগ পায় সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। এরপর থেকে নানান প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে বন্দরের কার্যক্ষমতা সচল রাখতে কাজ করছি আমরা। একসময় আমাদের কর্মীরা টার্মিনাল পরিচালনায় দক্ষ ছিল না। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে আজ যে প্রবৃদ্ধি, এর পুরোভাগ নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের কর্মীরা। দিন দিন তাদের দক্ষতাও বেড়েছে।’
কিন্তু এখন চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে সৌদি আরবের রেডসি গেটওয়ে। বে-টার্মিনালের দুটো টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে পোর্ট অব সিঙ্গাপুর ও ডিপি ওয়ার্ল্ড। চট্টগ্রাম বন্দরের আওতাধীন যে টার্মিনালটি ছিল তা পরিচালনায় যুক্ত হচ্ছে আবুধাবি পোর্ট। আগামীতে হয়তো মাতারবাড়ী বন্দর পরিচালনায়ও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া হবে।
এ বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশের সব প্রকল্পেই বিদেশি কোম্পানিকে স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজ করতে হয়। তাই এক্ষেত্রেও বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে দেশীয় কোম্পানিকে জয়েন্ট ভেঞ্চারে কাজের সুযোগ দিতে হবে। এতে দেশীয় কোম্পানিগুলো বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করে দক্ষতা অর্জন করতে পারবে এবং পরে দেশের বাইরে গিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে। ফলে আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো বিদেশে লাল সবুজের পতাকা উড়াবে এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।’
কোনো এক সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অপারেটর দ্বারা গ্যান্টি ক্রেনের মাধ্যেমে ঘন্টায় ১০-১২ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হতো, সেখানে সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের দক্ষ বিদেশী অপারেটর দ্ধারা ঘন্টায় ২৫-৩০ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতো সাইফ পাওয়ার টেক।
Leave a Reply