নাগরিক নিউজ ডেস্ক :
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের পরিচালক এনামুল করিমের বিরুদ্ধে উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগ। অভিযোগগুলোকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বন্দর ও সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত পর্যন্ত সবখানেই তার বিরুদ্ধে শুধুই অনিয়ম-দুর্নীতির চরম অভিযোগ বাড়ছে।
তার বিরুদ্ধে মিলছে নতুন নতুন তথ্য। এসব অভিযোগের কেন্দ্রে রয়েছে এনামুল করিমের কয়েক কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ক্ষতিসাধনের বিষয়গুলো।
জানা গেছে—টানা ১৭ বছর ধরে বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বন্দরের পরিবহনসংক্রান্ত সব অবৈধ লেনদেনের নিয়ন্ত্রণ করেছেন এই এনামুল। চট্টগ্রাম বন্দরের মোট ১৮টি প্রধান প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে পরিবহন বিভাগকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এই বিভাগের কাজ হলো পণ্য ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং থেকে শুরু করে জেটি ও টার্মিনাল অপারেশন, জাহাজ বন্দরে ভেড়ানো, লাইসেন্স প্রদানসহ সংশ্লিষ্ট সব ধরনের পরিবহন কার্যক্রম পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করা।
কিন্তু এই গুরুদায়িত্বপূর্ণ বিভাগের প্রধান হিসেবে এনামুল করিম ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে পাস করে বন্দরের কাজে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে পদোন্নতি পান। আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় এনামুল করিমের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে দুদক তদন্ত শুরু করে।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে মেসার্স ইউনিবেঙ্গল কনটেইনার ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড নামের একটি শিপিং এজেন্টের রিভলভিং হিসেবে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকা সত্ত্বেও এনামুল করিম তখন ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজারের (অপারেশন) দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বিধি লঙ্ঘন করে তাদের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ছাড়পত্র দেন। এর ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাওনা ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা আদায়ে সংকটে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুদক এ বিষয়ে বন্দর চেয়ারম্যানকে একাধিক চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় নথিপত্র এবং ওই সময়ের কর্মকর্তাদের বিবরণ জানতে চেয়েছে।
দুদকের চিঠিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এনামুল করিম শিপিং এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশ করে বন্দরের মাশুলের টাকা আত্মসাৎ করে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। তখন দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন ছিলেন অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত কর্মকর্তা।
বিষয়টি নিয়ে মো. এমরান হোসেন বলেন, আমার দায়িত্ব পালনকালে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো সহযোগিতা না করায় বিষয়টি দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে— গত ৪ জুন দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয় চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের কাছে এনামুল করিমের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে শিপিং এজেন্টের যোগসাজশে বিধি লঙ্ঘন করে বন্দরের পাওনা মাশুলের ১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চিঠি পাঠিয়েছেন দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা অংটি চৌধুরী (যার স্মারক নং-০০.০১.১৫০০.৭১১.০১.০০২.২৫.৩৩৬)।
উল্লেখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। এসব রেকর্ডপত্র গত ১৭ এপ্রিল সরবরাহ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
দুদক কর্মকর্তা বলেন—আমাদের কাছে সরবরাহ করা রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা চলছে। আমরা সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলছি। আমাদের তদন্ত এখনো চলমান। তবে এনামুল করিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রেকর্ডপত্র সরবরাহ করার বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো কর্মকর্তাই কথা বলতে রাজি হননি।
এসব অভিযোগ ছাড়াও ২০১৯ সালে প্রায় ১১ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের ঘটনায় এনামুল করিমের বিরুদ্ধে তদন্ত চলাকালে তাকে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ গেলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সেই তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে—এনামুল করিমের বিরুদ্ধে বর্তমানে চারটি দুর্নীতির মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলা ঢাকায় এবং দুটি চট্টগ্রামে বিচারাধীন। গত ২ আগস্ট সাংবাদিক জাওয়াদ নির্ঝর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনামুল করিম সম্পর্কে লেখেন, এনামুল করিম ৮০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক। এই অর্থ তিনি আমেরিকা ও দেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন।
অভিযোগ অনুযায়ী, আমেরিকায় তার বাড়ি এবং দেশে বেনামে বিপুল সম্পদ রয়েছে। জাওয়াদ নির্ঝর অভিযোগ করেছেন, এনামুল করিম নিজেকে কখনো আওয়ামী লীগ নেতা ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠজন, আবার বর্তমানে জামায়াত-বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচয় দেন।
অভিযোগ রয়েছে, বন্দরে সব শ্রমিক নিয়োগের নেপথ্যে তিনি কাজ করেন এবং প্রতিটি নিয়োগ থেকে ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। এই নিয়োগপ্রক্রিয়ায় তার বিশ্বস্ত এজেন্ট হিসেবে বন্দর শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি মীর নওশাদ, সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর ও সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল চৌধুরী কাজ করেন।
অভিযোগের বিষয়ে এনামুল করিমের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা ও হোয়াটসঅ্যাপ এসএমএস দিলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
Leave a Reply