চট্টগ্রাম নগরীর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই ফরমায়েশি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও অপ্রামাণিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হচ্ছে—এমন অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। শহরের প্রকৃত চাহিদা, ভূপ্রকৃতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। ফলে কোটি কোটি টাকার প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও নাগরিক ভোগান্তি বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সাবেক সভাপতি এবং সিডিএ বোর্ড সদস্য নগর পরিকল্পনাবিদ জেরিনা হোসেন বলেন, চট্টগ্রামের জন্য ১৯৬১, ১৯৬৫ এবং ১৯৯৫ সালে তিন দফা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন হলেও কোনোটি বাস্তবায়িত হয়নি। এখনও নতুন মহাপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তার কোনো সুপারিশ কার্যকর করা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, “সিডিএ ও সিটি করপোরেশন অনেক প্রকল্প নিয়েছে, কিন্তু সেগুলো মহাপরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা যাচাই না করে ‘সমীক্ষা রিপোর্ট’-এর ওপর নির্ভর করেই প্রকল্প অনুমোদন হয়।”
নগর পরিকল্পনাবিদরা মনে করেন, এই ধরনের “ফরমায়েশি সমীক্ষা” মূলত ঠিকাদারি স্বার্থ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য তৈরি হয়। এতে শহরের প্রকৃত প্রয়োজন, পরিবেশ এবং সামাজিক দিক বিবেচনা করা হয় না।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, নগরের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য নির্ভুল তথ্য অপরিহার্য। কিন্তু চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন, সিডিএ, পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস—কোনো সংস্থার কাছেই নির্ভরযোগ্য জনসংখ্যা বা যানবাহনের তথ্য নেই। “জনসংখ্যা ও যানচালনার পরিসংখ্যান ভুল হলে প্রকল্পও ভুল হবে। চট্টগ্রামে এখন ঠিক সেটাই ঘটছে,” তিনি যোগ করেন।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সূত্র জানায়, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে পর্যাপ্ত যানচাপ না থাকা সত্ত্বেও সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ‘উচ্চ ট্রাফিক’ দেখানো হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে, কিন্তু এর সুফল অনিশ্চিত। এ ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে নেওয়া সিডিএর মেগা প্রকল্পেও এখনো স্থায়ী সমাধান আসেনি। নালা ও খাল দখলমুক্ত না করেই সেখানে ব্যয়সাপেক্ষ নির্মাণ কাজ চলছে, ফলে বর্ষায় চট্টগ্রাম এখনো পানির নিচে ডুবে যায়।
ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার বলেন, সিডিএ, সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকল্প বাস্তবায়নের বড় বাধা। “এক সংস্থা রাস্তা কাটে, অন্য সংস্থা মেরামত করে না; ড্রেন খোঁড়া হয়, কিন্তু সংযোগ দেওয়া হয় না। ফলে উন্নয়নের বদলে হয় নাগরিক ভোগান্তি,” তিনি উল্লেখ করেন।
বেলার চট্টগ্রাম সমন্বয়ক মনিরা পারভীন বলেন, “উন্নয়নের নামে এখন চলছে এক ধরনের প্রতিযোগিতা—কে কত বড় প্রকল্প আনতে পারে। কিন্তু প্রকৃত উন্নয়ন মানে নাগরিকের জীবনমানের উন্নতি, সেটাই এখন হারিয়ে গেছে।”
নগর পরিকল্পনায় দীর্ঘদিন ধরে পেশাগত মান বজায় না রাখার ফলেই চট্টগ্রাম এখন দিশাহীন উন্নয়নের পথে চলছে। প্রকল্পের আগে প্রয়োজনভিত্তিক সমীক্ষা, পরিবেশগত প্রভাব বিশ্লেষণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে এই ধারা থামানো সম্ভব নয়। তাদের ভাষায়, “চট্টগ্রামকে সত্যিকারের উন্নত শহরে রূপ দিতে হলে কাগজের রিপোর্ট নয়—মাঠের বাস্তবতা, তথ্যনির্ভর পরিকল্পনা আর জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থাই হতে হবে মূল ভিত্তি।”