১ম পর্ব ——
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সনদ জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। বোর্ডের গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, আবদুল আজিজ ভুয়া শিক্ষাগত সনদ ব্যবহার করে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন। এ ঘটনায় বোর্ডে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
সূত্রমতে জানা যায়, আবদুল আজিজ ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পান। তিনি চাকরিতে যোগদানের সময় একটি ডিগ্রি সনদ জমা দেন, যা পরবর্তীতে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে জাল প্রমাণিত হয়। তদন্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান থেকে সনদ যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছে যে, তার দেওয়া ডিগ্রি কোনো বৈধ রেকর্ডে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া ওই সময় তিনি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেছিলেন, সেটির রেজিস্ট্রেশন নম্বরও অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল।
কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আজিজের প্রদত্ত ডিগ্রি সনদটি ১৯৯৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুত করা হয় এবং সেটি ব্যবহার করে তিনি সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ পান। পরবর্তীতে পদোন্নতির মাধ্যমে তিনি সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে আসেন। কিন্তু মূল যোগ্যতা ও সনদভিত্তিক যাচাইয়ে তার যোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় বিষয়টি তদন্তাধীন ছিল দীর্ঘদিন। অবশেষে শিক্ষা বোর্ডের বিশেষ কমিটি বিষয়টি যাচাই শেষে তার সনদকে ভুয়া হিসেবে ঘোষণা করে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দপ্তর থেকে জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আবদুল আজিজের চাকরি স্থগিত ও পদোন্নতি বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিবেদনটি ইতিমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। বিষয়টি অনুমোদিত হলে আনুষ্ঠানিকভাবে তার চাকরি বাতিলের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই অভিযোগ নতুন নয়। আমরা অনেকদিন ধরে সন্দেহ করছিলাম যে তার সনদে অসঙ্গতি রয়েছে। অবশেষে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের পর সেটি প্রমাণিত হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, “যে কর্মকর্তা দীর্ঘদিন শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বে থেকে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখছেন, তার সনদই যদি ভুয়া হয়, তাহলে এটা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বড় ধাক্কা।”
এদিকে বোর্ডের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিষয়টিকে ‘প্রশাসনিক দুর্নীতির বড় উদাহরণ’ হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে কিছু কর্মকর্তা যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই চাকরি পেয়ে যাচ্ছেন, যা নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলে। তাদের মতে, এই ঘটনার মাধ্যমে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও নজরদারির অভাব প্রকাশ পেয়েছে।
জানা গেছে, সেকশন অফিসার পদে নিয়োগের সময় ঘুষ ও অনিয়মের অভিযোগও ছিল আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগের সময় তিনি এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে চাকরি নিশ্চিত করেছিলেন। যদিও বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু বোর্ডের কিছু কর্মকর্তা দাবি করেছেন, এ বিষয়েও আলাদা অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা চাই না কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতি থেকে শিক্ষা বোর্ডের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হোক। কারও সনদ জাল প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটি অন্যদের জন্যও সতর্কবার্তা।”
আবদুল আজিজের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও নজরদারি শুরু হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বোর্ডের সব বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তাদের সনদ যাচাইয়ের কাজ শুরু হতে পারে। শিক্ষা বোর্ডে কর্মরত অন্য কর্মকর্তারাও এখন উদ্বেগে রয়েছেন, কারণ এ ঘটনা পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর প্রশ্ন তুলেছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের এই সনদ জালিয়াতির ঘটনা শুধু একজন কর্মকর্তার অনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, এটি নিয়োগ ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার দুর্বলতারও প্রতিফলন। শিক্ষা বোর্ডের অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ, নথি যাচাই ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি এই ঘটনার মাধ্যমে আরও একবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন বোর্ড যদি এই ঘটনায় কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে পারে, তবে তা ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং শিক্ষা প্রশাসনের ওপর জনআস্থা পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে।