প্রাইভেট পার্টনারের সম্পূর্ণ বিনিয়োগ। সাইনিং মানি হিসাবে ২৫০ কোটি টাকা এবং নির্মাণকালে সব মিলিয়ে প্রায় ৬,৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এপিএম। সরকার থেকে কোনো অর্থায়ন বা গ্যারান্টি প্রদান করা হচ্ছে না। নির্মাণের পর ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি। চুক্তির মেয়াদকালে আমাদের সব বাণিজ্যিক, সামাজিক ও পরিবেশগত শর্ত মেনে চললে মেয়াদ বৃদ্ধি করা যাবে। যতগুলো কনটেইনার তারা হ্যান্ডেল করবে, প্রত্যেকটার জন্য আমাদের একটি নির্দিষ্ট ফি দেবে। যত বেশি ভলিউম করবে, আমাদের আয় তত বেশি হবে। এর পাশাপাশি দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে অনেক ধরনের শর্ত আছে এই চুক্তিতে। যেমন, কোনো কনটেইনার হ্যান্ডেল করতে না পারলেও আমাদেরকে ন্যূনতম একটি ভলিউম ধরে তারা পেমেন্ট করবে। রেগুলেটর হিসেবে থাকছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
প্রশ্ন: ৩০ বছরের চুক্তি কি অনেক বেশি দিনের হয়ে গেল না?
উত্তর: ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি পিপিপি কাঠামোর ক্ষেত্রে একটা মাঝামাঝি মেয়াদকাল। অন্যান্য দেশে একই ধাঁচের চুক্তির মেয়াদকাল: ভারত ২০১৮ – মুম্বাই পোর্ট – ৬০ বছর; চীন ২০০৩ – সাংহাই পোর্ট – ৫০ বছর; ভিয়েতনাম ২০১০ – কাই মেপ পোর্ট – ৫০ বছর।
প্রশ্ন: চুক্তির পূর্ণাঙ্গ দলিল কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না?
উত্তর: শুধু বাংলাদেশ না, কোনো দেশের সরকারই পিপিপি চুক্তির মূল দলিল জনসম্মুখে প্রকাশ করবে না আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে। সরকারি ক্রয়নীতি ও পিপিপি গাইডলাইন অনুযায়ী পূর্ণ প্রকাশ নিরাপদ নয়, কারণ এটি ভবিষ্যৎ দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা সব প্রকাশ করে ফেললে আগামী সব চুক্তির দর কষাকষিতে আমরা ব্যাকফুটে চলে যাব। এছাড়াও চুক্তির দলিলে ব্যবসায়িক তথ্য ও অপারেশনাল কৌশল থাকে, যা গোপনীয়তার শর্ত দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। বিশ্বব্যাংক, ADB-এর মতো সংস্থাগুলোও সম্পূর্ণ চুক্তি প্রকাশ না করে বরং সারাংশ প্রকাশের পরামর্শ দেয়। এতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে, আবার বেসরকারি অংশীদারের গোপনীয়তা রক্ষাও হয়। লালদিয়ার ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলো প্রযোজ্য। জনগণের অবহিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য (যেমন: মালিকানা, আয় কাঠামো) আমরা ইতোমধ্যে প্রেস ব্রিফিং করে প্রকাশ করেছি এবং সাংবাদিকদেরও লিখিত জানিয়েছি।
প্রশ্ন: অপারেটর বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কি স্বচ্ছ/আইনানুগ ছিল?
উত্তর: পিপিপি নীতিমালার জি–টু–জি পদ্ধতির আলোকে টেন্ডার আহ্বান, প্রাক–যোগ্যতা যাচাই, টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল মূল্যায়ন এবং ডিউ ডিলিজেন্সের মাধ্যমে অপারেটর চূড়ান্ত করা হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নিযুক্ত করা হয়েছে নিরপেক্ষ টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার, আইনজীবী, কনসালট্যান্ট। গঠন করা হয়েছে আন্তমন্ত্রণালয় টেন্ডার কমিটি। প্রতিটি ধাপের অডিটযোগ্য রেকর্ড সংরক্ষণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন: আমরা কি শ্রীলঙ্কার পথে হাঁটছি?
উত্তর: শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্রবন্দর চীনা ঋণে নির্মিত। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কান সরকার ৯৯ বছরের জন্য চীনা কোম্পানির কাছে কন্ট্রোলিং ইকুইটি স্টেক দিয়ে দিতে বাধ্য হয়। হাম্বানটোটার শিক্ষা হলো—অতিরিক্ত ঋণনির্ভর কাঠামো ও দুর্বল রিস্ক–শেয়ারিং মডেল দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য ক্ষতিকর। আমরা ওই পথে হাঁটিনি। লালদিয়া টার্মিনালের মালিক রাষ্ট্র এবং আগেই বলেছি, এটির জন্য আমরা কোনো ঋণ নেইনি—এটি সম্পূর্ণরূপে এপিএম-এর বিনিয়োগ। চুক্তিতে ট্রাফিক স্টাডি, রিস্ক শেয়ারিং, কারেন্সি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং স্টেপ–ইন রাইটের মতো বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যাতে অর্থনৈতিক কাঠামো টেকসই ও স্বচ্ছ থাকে।
প্রশ্ন: অপারেটর ব্যর্থ হলে বা চুক্তি ভঙ্গ করলে কী করবে সরকার?
উত্তর: চুক্তিতে পারফরম্যান্স–ভিত্তিক KPI, রেমেডি ও পেনাল্টির ধারা, স্টেপ–ইন রাইট, টার্মিনেশন এবং হ্যান্ড–ব্যাকের মতো প্রভিশন অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা জনস্বার্থ সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপারেটর চুক্তি ভঙ্গ করলে বা প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স দিতে ব্যর্থ হলে এসব ধারা অনুযায়ী সরকার বা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সময়ে পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং বিকল্প ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিতে পারে।
প্রশ্ন: বিদ্যমান টার্মিনালগুলো সমস্যা না মিটিয়ে নতুন টার্মিনাল কেন?
উত্তর: বর্তমান টার্মিনালগুলোতে ডিজিটাইজেশন, ইয়ার্ড রিডিজাইন, গেট অপ্টিমাইজেশন, কনটেইনার ব্যবস্থাপনার সংস্কার চলছে। অন্যদিকে লালদিয়ায় বিশ্বমানের কনটেইনার টার্মিনাল যোগ হলে অপারেশনাল প্রতিযোগিতা বাড়বে। বন্দর অবকাঠামোর ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই এই প্রকল্পটি একই সাথে বটলনেক রিমুভাল এবং নতুন সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ করবে।
প্রশ্ন: সবকিছু এত তাড়াতাড়ি হচ্ছে কেন?
উত্তর: আশ্চর্য! সারাজীবন শুনলাম সরকারি অফিস ঢিলা। ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট সময়মতো করতে পারলে আমাদের দেশ নাকি কোথায় চলে যেত! এখন যখন সরকারের কিছু অন্তপ্রাণ অফিসার লেজার ফোকাস নিয়ে দিনরাত খেটে একটা বড় কাজ এগিয়ে নিয়ে গেল, তখন তো সবার বলা উচিত—“They made us fly!!” কারও সাথে মিল খুঁজবেন না। ওটা কাকতাল।
প্রশ্ন: আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে কি?
উত্তর: নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, ইমিগ্রেশন, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার নিরাপত্তা প্রটোকল যথারীতি বলবৎ থাকবে। লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল এই নেটওয়ার্কের মধ্যেই অপারেট করবে। এছাড়া টার্মিনালে ব্যবহৃত সব ধরনের প্রযুক্তি ও অপারেশনাল প্রক্রিয়ায় সরকার অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী ডেটা লোকালাইজেশন, সাইবার সিকিউরিটি ব্যবস্থা, ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিনিং এবং অ্যাক্সেস–কন্ট্রোল মেকানিজম নিশ্চিত করা হবে। এই পুরো ব্যবস্থাপনাই সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে, ফলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কোনো সুযোগ নেই।
প্রশ্ন: সব মিলিয়ে দেশের কী লাভ হবে?
উত্তর: প্রতি বছর অতিরিক্ত ৮ লাখ TEU ধারণক্ষমতা যুক্ত হবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি। প্রতি ইউনিটে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে। আমদানি–রপ্তানি দ্রুততর হবে। এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারবে। বিশ্বের দূরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সরাসরি জাহাজ সংযোগের সুযোগ উন্মুক্ত হবে। ৫০০–৭০০ সরাসরি স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি হবে নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে; হাজারেরও বেশি পরোক্ষ কর্মসংস্থান হবে পরিবহন, লজিস্টিকস ও বৃহত্তর সাপ্লাই চেইনে। এপিএম টার্মিনালসের নিজস্ব ট্রেনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকরা বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ পাবেন। ডিজিটাল টার্মিনাল অপারেশন সিস্টেম, LEAN পদ্ধতি ও FLOW Framework-এর মাধ্যমে প্রযুক্তি ও দক্ষতা স্থানান্তর হবে। আমাদের প্রথম পরিবেশবান্ধব গ্রিন পোর্ট হবে এটি।