চট্টগ্রামে আবারও বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। বছরের শেষ প্রান্তে এসে হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বাড়ছে দ্রুত। নভেম্বরের প্রথম দুই দিনেই শনাক্ত হয়েছেন ৮৭ জন নতুন রোগী, গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন আরও ৪১ জন। বৃষ্টি থেমে গেলেও মশার দৌরাত্ম্য থামছে না। চিকিৎসকেরা বলছেন, এই সংক্রমণ কেবল আবহাওয়ার কারণে নয়, বরং সিটি করপোরেশনের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাবই এর জন্য মূলত দায়ী।
নগরজুড়ে মশা নিধনের কার্যক্রম কেবল কাগজেই সীমাবদ্ধ। ওষুধ ছিটানোর নাম আছে, কিন্তু বাস্তবে কার্যকারিতা নেই। ড্রেনের জমে থাকা পানি, নির্মাণাধীন ভবনের খোলা ছাদ, বাসাবাড়ির ফুলের টব—সব জায়গায় এডিস মশার বংশবিস্তার চলছে বাধাহীনভাবে। গত বছরের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পরও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো টেকসই বা ধারাবাহিক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, জানুয়ারি থেকে নভেম্বরের শুরু পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫৯২ জন মানুষ। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর মাসেই আক্রান্ত হয়েছেন ৯৯০ জন, সেপ্টেম্বরে ছিলেন ৯৩৫ জন। সংক্রমণ কমার পরিবর্তে উল্টো বেড়েই চলছে। অথচ নগরজুড়ে মশা দমন কার্যক্রমের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, শয্যা সংকটের মধ্যে রোগীরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। অনেকেই ভর্তি না হয়ে বহির্বিভাগেই স্যালাইন নিচ্ছেন। চিকিৎসকেরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের উপসর্গ আরও জটিল। কারও কারও মধ্যে ‘শক সিনড্রোম’ দেখা দিচ্ছে, অনেকের বমি ও ডায়রিয়া হচ্ছে—যা রোগের গুরুতর পর্যায় নির্দেশ করে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. এ এস এম লুৎফুল কবির বলেন, “আমাদের হাসপাতালে এখন ১৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। অনেকের মধ্যে সতর্ক সংকেত দেখা যাচ্ছে। বমি ও ডায়রিয়া দেখা দিলে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যেতে পারে। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে ঝুঁকি বেড়ে যায়।”
চিকিৎসকদের মতে, সিটি করপোরেশন সারা বছর মশা দমন কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা রাখতে পারেনি। ওষুধ কেনা, সংরক্ষণ ও ব্যবহার—সবখানেই অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা ছিল। নাগরিকদের অভিযোগ, নির্দিষ্ট এলাকায় ওষুধ ছিটানোর কথা বলা হলেও অনেক জায়গায় সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোনো দল দেখা যায় না। ওষুধের গন্ধ বা প্রভাবও বোঝা যায় না। এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে অভিযান কার্যত বন্ধ ছিল পুরো অক্টোবর মাসজুড়ে।
সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁরা নিয়মিত ওষুধ ছিটাচ্ছেন এবং হটস্পট এলাকায় বাড়তি নজরদারি চালাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। আগ্রাবাদ, হালিশহর, চান্দগাঁও, লালখান বাজার, কোতোয়ালি, খুলশীসহ অন্তত ২৫টি এলাকা এখন ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে। বৃষ্টি শেষে জমে থাকা পানিতে লার্ভা ধ্বংস না হওয়ায় মশার সংখ্যা দ্রুত বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক উদ্যোগ যেমন জরুরি, তার চেয়েও বেশি দরকার নাগরিক সচেতনতা। কিন্তু নগরের বড় অংশে মানুষ জানে না কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে বা কিভাবে নিজের বাসার আশপাশে মশার প্রজনন বন্ধ করা যায়। সিটি করপোরেশনের প্রচারণা কার্যক্রমও প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানুষও উদাসীন থেকে যাচ্ছে। ফলে মশার বংশবিস্তার বাড়ছে, সংক্রমণও লাফিয়ে উঠছে।
এদিকে চিকুনগুনিয়ার সংক্রমণ তুলনামূলক কমেছে। এ বছর এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৬৯ জন, তবে অক্টোবর মাসে তা নেমে আসে মাত্র ১২১ জনে। নভেম্বরের প্রথম দুই দিনে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন একজন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকলে ডেঙ্গুর সংক্রমণও ধীরে ধীরে কমে যাবে। কিন্তু নভেম্বরের শুরুতে সম্ভাব্য লঘুচাপ ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাত সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
চট্টগ্রামের ডেপুটি সিভিল সার্জন মোহাম্মদ তৌহিদুল আনোয়ার বলেন, “বৃষ্টি হওয়ার পর প্রায় ২৮ দিন পর্যন্ত মশার প্রজনন থাকে। তাই একটানা বৃষ্টি বা থেমে থেমে বৃষ্টি হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যায়।”
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ বাড়ার দায় কেবল আবহাওয়ার কাঁধে চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না নগর কর্তৃপক্ষ। বারবার একই অভিজ্ঞতার পরও তারা কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। নাগরিকদের ক্ষোভও তাই ক্রমেই বাড়ছে। চট্টগ্রামবাসী এখন জানতে চায়—প্রতিবারই কি একই ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি হবে, নাকি এবার সত্যিই জেগে উঠবে নগরের কর্তা প্রতিষ্ঠান?