এর জবাব খুব সহজ নয়। বরং অনেক কঠিন। কেননা, প্রশ্ন অনৈতিক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের হাত থেকে পরিত্রান পাওয়ার নয়, মুখ্য প্রশ্ন তো আমাদের অজ্ঞানতা দূর করার। যতদিন পর্যন্ত আমরা অজ্ঞানী থাকব, সুশিক্ষা হতে বঞ্চিত থাকব, অশিক্ষায় আচ্ছন্ন থাকব, ততদিন কেহ না কেহ আমাদেরকে শোষণ করতে থাকবেই। কেহ না কেহ লুঠ করতে থাকবেই। কেহ না কেহ প্রভূত্ব করতে থাকবেই। পুরোহিতেরা শোষণ করবে, ধর্মগুরুরা শোষণ করবে, মোল্লা-মৌলভীরা শোষণ করবে বাহুবলীরা শোষণ করবে এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও শোষণ করবে। যতদিন পর্যন্ত সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জাগ্রত হতে পারবোনা, ততদিন আমরা শোষণ হতেই থাকব। রাজনৈতিক নেতা হোক বা ধর্মগুরু হোক, তাতে কোনো পার্থক্য নাই। যে কোন পতাকার আড়ালে হোক বা ব্যানারের আড়ালে সর্বদা সবাই লুঠ করতে থাকবেই। আমাদের অশিক্ষা এবং কুশিক্ষা যতদিন দূর হবেনা, ততদিন আমাদেরকে সকলেই লুঠ ও শোষণ করতে থাকবে।
সমাজবাদী হোক বা সাম্যবাদী হোক অথবা ধর্মবাদী, তাতে কি আসে যায়? যে কোনো পতাকাবাহী হোক না কেন, অশিক্ষা-কুশিক্ষা থাকলে শোষণের হাত হতে বাঁচার উপায় নাই। সময়ে সময়ে লুঠেরাদের কেবল নাম পরিবর্তন হবে। রং পরিবর্তন হবে। কিন্তু সবাই লুঠেরা। তারা লুঠ করবেই। আমরাই হবো লুঠের শিকার। এরূপ প্রশ্ন করার দরকার নাই যে, রাজনৈতিক লুচ্চা-গাদ্দারদের হাত হতে দেশ-সমাজ কখন মুক্ত হবে? এ প্রশ্ন অর্থহীন। বরং ইহাই প্রশ্ন করা উচিত যে, আমরা কখন জাগ্রত হবো? আমাদেরকে এত বেশী জাগ্রত হতে হবে যে, যাতে সত্যকে সত্য বলতে পারি এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারি। এখন লোভের কারণে, দ্বেষের কারণে এবং মোহের কারণে লোক সত্যকে সত্য বলতে ভয় পায়, মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে ভয় পায়। সৎ সাহস নাই। অর্থ, ক্ষমতা, বাহুবল মানুষকে অন্ধ করে রেখেছে।
সত্য হোক বা মিথ্যা হোক, দুর্বল কিংবা সবল সবাই ক্ষমতার পেছনে, অর্থের পেছনে অন্ধের মত ছুটতে থাকে। কে কাকে পদ দলিত করতে পারে, কে কাকে পেছনে ফেলতে পারে, কে কাকে হেনস্থা করতে পারে, কে কার সম্মান হানি করতে পারে, কে কাকে ডিঙ্গিয়ে ক্ষমতাবান হতে পারে, বৈধ পথে হোক বা অবৈধ পথে হোক কে কত সম্পদের পাহাড় গড়তে পারে, কে কত বড় তথা কত অধিক আলিসান বাড়ি বানাতে পারে, কেক কত দামী গাড়িতে চড়তে পারে ইত্যাদির মোহে বিভোঢ় হয়ে রয়েছে। মনুষ্যত্ববোধ, মানবতাবোধ, নীতি-নৈতিকতাবোধ যেন কোথাও উদাও হয়ে গিয়েছে। আনন্দ-উল্লাসে পশুর গলা কাটতে কাটতে এখন সর্বত্র মানুষের গলা কাটারও মহোৎসব চলছে। কোনো অপরাধবোধ নেই কারো কাছে। কেহ কাউকে রাখ-ঢাক করে কিংবা ছাড় দিয়ে কথা বলে না। ক্ষমার অনুশীলন নাই, সহিষ্ণুতা নাই। একটা আঙ্গুলের পরিবর্তে দু’টা আঙ্গুল দেখানোর নীতি চলছে যত্রতত্র।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্রই চলছে শিক্ষার চেয়ে বাহুবলের প্রভাব। ক্ষমতার দাপট। অর্থের মহড়া। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, ধর্ম সর্বত্রই চলছে ক্ষমতার দাপট। বাহুবল, অর্থ, ক্ষমতা যার দিকে, সবকিছু তারই নিয়ন্ত্রনে। দিনকে রাত করতে, ন্যায়কে অন্যায় করতে, ধর্মকে অধর্ম বলতে, সুবিচারকে অবিচার করতে, সদাচারকে দূরাচার করতে তাদের কোনো বাঁধা নাই। সব রকমের অনাচারই তাদের ক্ষেত্রে সদাচার। এরকম নারকীয় পরিবেশ একদিনে হঠাৎ তৈরী হয়নি। দীর্ঘদিন হতে চলে আসা অনিয়মের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার ফসল হল আজকের এ ভয়ানক অরাজক পরিস্থিতি। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার সমস্ত অবকাঠামোই দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার। ভেঙ্গে পড়েছে সবকিছু। দীর্ঘকাল হতে চলে আসা ঘুষ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলীয় করণ, ধর্মান্ধতার প্রশ্রয় ইত্যাদিই দায়ী এরকম নৈরাজ্যকর অবস্থার। আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে দুর্নীতি। নিজেরা পরিশোধিত না হলে, সুশিক্ষা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কুশিক্ষা দূর করতে না পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রে কখনও শান্তি-সুখ প্রতিষ্ঠিত হবেনা।
যতদিন পর্যন্ত সকল মনুষ্য জাতি, সম্প্রদায় ও ধর্মের বেড়াজাল ভাঙ্গতে পারবেনা, অন্যায়ের বেড়াজাল ভাঙ্গতে পারবেনা, অন্ধ ক্ষমতার মোহজাল ভাঙ্গতে পারবেনা, ততদিন শান্তির কথা বলাও বাতুলতা মাত্র। প্রথমে নিজেদের মধ্যে জাগরণ আনতে হবে, সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। অসত্যকে অসত্য বলার সৎ সাহস সৃষ্টি করতে হবে, মিথ্যাকে মিথ্যা বলারও অদম্য সাহস সৃষ্টি করতে হবে। তজ্জন্য সুশিক্ষা অর্জনের চেয়ে অন্য কোনো উত্তম বিকল্প নাই।
নাগরিকনিউজ/তাপস বড়ুয়া
Leave a Reply