বিশ্ব শান্তির মৈত্রী প্রদীপ আধ্যাত্নিক জ্যোতির্ময় পুণ্যপুরুষ দেব মানব পূজ্য প্রতিসম্ভিদাসহ ষড়াভিজ্ঞ অর্হৎ ” অনুবুদ্ধ ” ভদন্ত শীলানন্দ মহাস্থবির (ধুতাঙ্গ ভান্তে) মহোদয়ের সংক্ষিপ্ত জীবনী।
একুশ শতকের বিশ্বশান্তির অগ্রদূত, আধ্যাত্মিক সাধনাসিদ্ধ ক্ষণজন্মা, আলোকিত জ্যোতির্ময় মহাপুণ্যপুরুষ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আর্য্যশ্রাবক, দেব-মানব পূজ্য প্রতিসম্ভিদাসহ ষড়াভিজ্ঞ অর্হৎ ‘অনুবুদ্ধ’ শ্রীমৎ শীলানন্দ মহাস্থবির (ধুতাঙ্গ ভান্তে)। জন্মঃ ১৯৭৭ খ্রিঃ ২৬ ডিসেম্বর, চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনীয়া উপজেলাস্থ সোনাইছড়ি গ্রাম। গৃহী নাম: বিকাশ বড়ুয়া, পিতা: প্রয়াত বাবু হেমরঞ্জন বড়ুয়া, মাতা: শ্রীমতি নীলুপ্রভা বড়ুয়া। চার ভাই-বোনের মধ্যে বিকাশ দ্বিতীয়। বড় ভাই প্রয়াত ডা: প্রকাশ বড়ুয়া, ছোট ভাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি. গবেষণারত ভদন্ত প্রিয়ানন্দ স্থবির ও একমাত্র ছোট বোন শ্রীমতি শুক্লা বড়ুয়া। শিশুকাল থেকেই বিকাশ ছিলেন- শান্ত-দান্ত, ধীর-স্থির ও কোমল মেজাজের। বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন- বিচক্ষণ। আচার-আচরণ ছিল- নম্র-ভদ্র-গম্ভীর ও সৎ-স্বভাবের। অর্থাৎ গ্রামের অন্য আট-দশ জন ছেলেদের মধ্যে বিকাশ ছিলেন- সম্পূর্ণ ভিন্ন একাকী, নিঃসঙ্গ-নিভৃতচারী ও ভাবুক পিয়াসী। প্রায়শই নিরিবিলিতে চিন্তামগ্ন থাকতে পছন্দ করতেন। তাই সময় পেলেই একাকী নির্জনে নীরবে কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে কি যেন ভাবতেন আর অল্পতেই তুষ্ট হতেন।
শিক্ষা
তিনি ৬ বছর বয়সে ১৯৮৩ খ্রিঃ ছদর আলী প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন
এবং ১৯৮৯ খ্রি: সাহাব্দী নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ
শ্রেণীতে ভর্তি হন। কালের রথ মহাকালের পথে
এগিয়ে চলে। শিশু বিকাশ ও দেখতে দেখতে ১১
বছরে পা রাখলেন। তাঁর মা হঠাৎ একদিন তাঁকে
শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ৫
মে ১৯৮৮ খ্রিঃ রোজ বৃহস্পতিবার শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমা (বৈশাখী পূর্ণিমা) তিথিতে মাত্র ১১ বছর বয়সে শতবর্ষের পুরনো ঐতিহ্যবাহী সোনাইছড়ি রাজ বিহারের অধ্যক্ষ ভদন্ত লোকানন্দ মহাস্থবির এর নিকট প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত করে দেন। তখন কেই-বা জানত যে, সে দিনই শিশু বিকাশ চিরতরে সংসারের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করবেন। প্রব্রজ্যা ধর্মে দীক্ষিত করে ধর্মীয় রীতি অনুসারে বিকাশের নাম রাখা হল- শ্রীমৎ শীলানন্দ শ্রামণ। শুরু হল নতুন যাত্রা। প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর দিন থেকে প্রতিদিন সকালে গ্রামে গিয়ে ভিক্ষা করে আহার সংগ্রহ করতে হত। এদিকে পাঠ্য শিক্ষার পাশাপাশি তিনি গৌতম বুদ্ধের নির্দেশিত শীল-বিনয়, আচার-আচরণ, নিয়ম-নীতি সহ ধর্মীয় সুত্রাদি শিক্ষা করতে লাগলেন এবং অল্প দিনের মধ্যে গৌতম বুদ্ধের আবিষ্কৃত একমাত্র দুঃখ মুক্তির উপায় মহাসতিপট্ঠান সূত্র, ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র, অনত্মলক্ষন সূত্র সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূত্র মুখস্থ করে ফেললেন। সাথে প্রতিদিন ধ্যান অভ্যাস ও চলতে লাগল। কিন্তু আরো উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষা লাভের জন্য তাঁকে এবার রাউজান উপজেলাধীন কদলপুরস্থ ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি করে দেওয়া হল। তিনিও গভীর মনোনিবেশের সাথে পালিভাষা, শ্রামণের শিক্ষা ও ধর্মপদ গ্রন্থ সহ বেশ কিছু ধর্মীয় গ্রন্থ শিক্ষা করে ধর্ম-বিনয়ে পারদর্শী হয়ে উঠলেন। অপর দিকে সাহাব্দী নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৭ম শ্রেণী পাশ করে ১৯৯১ খ্রিঃ পুন: আধারমানিক উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৯৪ খ্রি: মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি পরীক্ষায় উর্ত্তীন হন এবং ইমাম গাজ্জালী ডিগ্রী কলেজ থেকে ১৯৯৬ খ্রি: কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন। একইভাবে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। বাংলাদেশ পালি ও সংস্কৃত বোর্ডের অধীনে ত্রিপিটকের মধ্যে সূত্র পিটকের উপর অনুষ্ঠিত আদ্য-মধ্য-উপাধি পরীক্ষায়ও সাফল্যের সাথে উর্ত্তীন হয়ে ত্রিপিটক শিক্ষায় বুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি প্রায়শই নির্জনে নিরিবিলিতে ধ্যান-মগ্ন হয়ে জন্ম-জরা-ব্যাধি, মৃত্যু নামক দুঃখ থেকে চিরতরে মুক্তির কামনায় প্রয়াস চালাতে গিয়ে মুক্তির আকাঙ্খা দিনের পর দিন প্রবল আকার ধারন করতে থাকে। যার ফলে চিন্তা করলেন এখানে থাকলে মুক্তি সম্ভব নয়। তাই এখান থেকে আমাকে বের হতে হবে।
অতপর ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টার ত্যাগ করে চলে গেলেন
রাউজান উপজেলাধীন গহিরা অংকুর ঘোনাস্থ
মহাশ্মশান ভাবনা (ধ্যান) কেন্দ্রে। শ্মশানে তিনি
প্রতিনিয়ত মানুষের মৃতদেহ পোড়ানো ও তাদের
আত্মীয়-স্বজনের করুন হৃদয় বিদারক কান্নার দৃশ্য
দেখে তাঁর মনের মনিকোটায় নিদারুন এক সংবেগ
উৎপন্ন হল এবং দুঃখকে তাঁর মানসপটে দাবানলের
অগ্নিকুন্ড তুল্যসম প্রতিভাত হল। যার দরুন দুঃখ
নামক দাবানলের অগ্নিকুন্ড থেকে পরিত্রাণের জন্য
আত্মমুক্তির কর্ম সম্পাদনে আরো মনোযোগী হয়ে
ধ্যান মগ্ন হলেন। এখানে ধ্যানকালীন সময়ে তাঁকে
মাঝে মাঝে বিভিন্ন গ্রামে ধ্যান শিক্ষা (ধ্যান কোর্স)
পরিচালনা করার জন্য প্রার্থনা করে নিয়ে যেতেন।
তাই নিজের ধ্যান অনুশীলনের ফাঁকে মানুষের
মঙ্গল-কল্যাণ সাধনের জন্য বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে
মুক্তিকামী মানুষদের সহকারী হিসেবে ধ্যান শিক্ষা
দিতেন। তাদের মধ্যে- ১। আবুরখীল গ্রামস্থ-
অজন্তা বিহার, ২। পোমরা গ্রামস্থ- জ্ঞানাংকুর মৈত্রী
বিহার, ৩। সৈয়দবাড়ীস্থ ধর্মচক্র বিহার, ৪।ধুমারপাড়াস্থ আনন্দ বিহার উল্লেখযোগ্য। দিন গড়াতে গড়াতে শীলানন্দ শ্রামনের ২০ বছর পূর্ণ হলে ধর্মীয় বিধি মোতাবেক অনেক প্রাজ্ঞ-পন্ডিত ভিক্ষু সংঘের উপস্থিতিতে ১৯৯৮ খ্রিঃ ২৬ জুন অংকুর ঘোনা জেতবনারাম বৌদ্ধ বিহারের ভিক্ষু সীমায় অষ্টম সংঘরাজ ভদন্ত শীলালংকার মহাস্থবির মহোদয়ের নেতৃত্বে মহাসাড়ম্বরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে উৎসব মুখর পরিবেশে তাঁকে উপসম্পদা প্রদান করে ভিক্ষু ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। ভিক্ষু হওয়ার পর তিনি আরো নব উদ্যমে ধ্যান-ভাবনায় রত হলেন। এখানে প্রায় ২ বছর সাধনার ফলে তাঁর দুঃখ মুক্তির প্রবল ইচ্ছা যখন আরো তীব্র হল। তখন সেখানে অবস্থান করে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনে, মুক্তির টানে সম্পূর্ণ একাকী সঙ্গীবিহীন জনকোলাহলহীন নীরব-নিস্তব্ধ ধ্যান উপযোগী নির্জন অরণ্যের খোঁজে অংকুর ঘোনা মহাশ্মাশান ভাবনা কেন্দ্র ত্যাগ করে অজানা-অচেনা পার্বত্য অঞ্চলের দিকে ছুটলেন। সঙ্গী ছিল কেবল ২২৭ শীল সম্বলিত ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ ও ১৩ প্রকার ধুতাঙ্গশীল সম্বলিত পরমার্থ ধুতাঙ্গশীল অনুশীলন ও গৃহী কর্তব্য নামক এ দুটি গ্রন্থ এবং ব্যবহার্য অষ্ট উপকরণ। যথা- দোয়াজিক, একাজিক, অন্তর্বাস, কটিবন্ধনী, ভিক্ষাপাত্র, জলছানী, ক্ষুর, সুই-সুতা।
উল্টাছড়ি গমন
মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৯৯৯ খ্রিঃ ১০ই ডিসেম্বর
যেতে যেতে সেই চির অচেনা-অজানা খাগড়াছড়ি
জেলার মহালছড়িধীন উল্টাছড়িস্থ দশবল বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে প্রবেশ করলেন। বুদ্ধ প্রতিবিম্বের
সামনে বসে দীর্ঘ ৭ বছরের কঠোর সংকল্প নিয়ে ৭টি
ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করলেন। সংক্ষেপে- ১।ত্রিচীবরিক- দোয়াজিক, একাজিক ও অন্তর্বাস এ তিনটি মাত্র কাপড়ে (চীবরে) অধিষ্ঠানকাল পর্যন্ত অতিবাহিত করাই ত্রিচীবরিক ধুতাঙ্গ।২। পিন্ডপাতিক- ভিক্ষার মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করাই পিন্ডপাতিক ধুতাঙ্গ। ৩। সপদানচারিক- উৎকৃষ্ট-নিকৃষ্ট, ধনী-গরীব বিবেচনা না করে সকলের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করাই সপদানচারিক ধুতাঙ্গ। ৪। একাসনিক- ২৪ ঘন্টায় (দিনের ১২টার পূর্বে) একবার মাত্র খাদ্য-ভোজ্য আহার করে জীবন ধারন করাই একাসনিক ধুতাঙ্গ। ৫। পাত্রপিন্ডিক- একটি মাত্র ভিক্ষাপাত্রে খাদ্য-ভোজ্য ভোজন করাই পাত্রপিন্ডিক ধুতাঙ্গ। ৬। খলুপচ্ছাভত্তিক কোনো খাদ্য একবার প্রত্যাখ্যান করার পর সেদিন আর কোনো খাদ্য-ভোজ্য ভোজন না করাই খলুপচ্ছাভত্তিক ধুতাঙ্গ।
৭। যথাসন্ততিক- গাছের ঝড়ে পড়া মরা পাতার বিছানা হোক কিংবা খড়ের বিছানা অথবা ত্রিপলের বিছানা, যে বিছানা হোক না কেন, সাধক ভিক্ষু তাতেই সন্তুষ্ট থাকাই যথাসন্ততিক ধুতাঙ্গ। ধুতাঙ্গ মানে সংক্ষেপে গৌতমবুদ্ধ নির্দেশিত উচ্চতর শীল-সংযম ও সর্বোচ্চ ত্যাগের অঙ্গ বা কর্মপন্থা। যাকে কৃচ্ছসাধন বললেও অত্যুক্তি হবে না। ধুতাঙ্গশীল অধিষ্ঠান করে ভান্তে তৃষিত চাতক পাখির মত আত্মমুক্তির প্রত্যয়ে কয়েকজন এলাকাবাসী নিয়ে প্রবেশ করলেন- সেই চির অচেনা-অজানা ঘন ঝোপ-ঝাড়ে আবেষ্টিত নীরব-নীস্তব্ধ বিপদশংকুল ভয়ংকর গহীন অরণ্যে। যেখানে দিনের বেলায় সূর্য্যের কিরণ ভেদ করে প্রবেশ করতে পারত না। পুরো অরণ্য বড় বড় গাছ-পালা, সেগুন বাগান, বাঁশ বন আর ঝোপ-ঝাড়ে ভীতিকর এক পরিবেশ। এগিয়ে যেতেই বিশাল এক পাগজ্যা গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালেন। এলাকাবাসী ভান্তেকে জানালেন- ভান্তে এই গাছটি অনেক পুরনো এবং এটাতে অপ-দেবতা থাকে। তাছাড়া এ জঙ্গলে গরু রুপী একটি খারাপ দেবতাও আছে। তাই দিনের বেলায়ও এখানে কেউ আসতে সাহস করে না, সবাই ভয় পায়। সে কথা শুনে ভান্তে সেই গাছ তলেই ধ্যান করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আরো তিনটি ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করলেন। ১। আরণ্যিক- লোকালয় বর্জন করে রাত-দিন জঙ্গলে (অরণ্যে) শয়নাসন গ্রহণ করাই আরণ্যিক ধুতাঙ্গ। ২। বৃক্ষমূলিক- ছাউনীযুক্ত ঘর, কুঠির, গুহা পরিত্যাগ করে শুধুমাত্র বৃক্ষতলে শয়নাসন গ্রহণ করাই বৃক্ষমূলিক ধুতাঙ্গ। ৩। নৈসজ্জিক- শয্যাসুখ বা বিছানায় পৃষ্ঠ শয়ন ব্যতীত দাড়নে-গমনে (হাঁটা) উপবেশনে এ তিন ঈর্যাপথে দিন-রাত ধ্যানের মাধ্যমে অতিবাহিত করাই নৈসজ্জিক ধুতাঙ্গ। ১৩ প্রকারের মধ্যে উক্ত ১০টি ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করে আসন পাতেন ঝড়ে পড়া মরা শুকনো পাতার উপর। হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু বজ্র কঠিন সংকল্পে ব্রতী হয়ে জীবন ও প্রাণের মায়া বিসর্জন দিয়ে পাহাড়ী জীব-জন্তু,ভূত-প্রেত-অপদেবতার ভয় ভীতিকে উপেক্ষা করে বসে পড়লেন একাকী সঙ্গীবিহীন ভীতিপূর্ণ পাগজ্যা গাছের নীচে মরা পাতার আসনের উপর। শুরু হল ক্ষুধা-পিপাসা-তৃষ্ণা নামক শত্রুর সঙ্গে মহাসতিপট্ঠানসূত্র অনুযায়ী অস্ত্রবিহীন যুদ্ধ। অস্ত্র ছিল কেবল- বুদ্ধের নির্দেশিত ভিক্ষুদের ২২৭ শীল, ১৩ প্রকার ধুতাঙ্গশীল, ১৪ প্রকার খন্ধক ব্রত, ৮০ প্রকার মহাব্রত আর অপরিসীম মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা নামক চারি ব্রহ্মবিহার। ভান্তে কঠোরতার সাথে ধ্যান অনুশীলনের প্রত্যয়ে সাধনায় মগ্ন হলেন। ধ্যানে মগ্ন হওয়ার পর প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় পাহাড়ের জঙ্গলী অগনিত বিষাক্ত মশা-মাছি, পোকা-মাকড়, পিঁপড়া-চেঁওড়া, আটালী-ওড়লী, খজা-ডাঁশ, বিছা-জোঁক সহ বিবিধ প্রকারের কীট-পতঙ্গের সঙ্গে। এগুলোর উপদ্রব আর অনব্রত কামড়ে অসহ্য-যন্ত্রনা-ব্যথা-বেদনায় শরীর যেন কাতরাতে শুরু করল। সাথে পাহাড়ী অপদেবতা-ভূত-প্রেতের ভয়ভীতি আর নানা প্রকারের বিষাক্ত সাপের উপদ্রবে মৃত্যুর আশংকায় ভান্তেকে যেন ভাবিয়ে তুলল। তাছাড়া নৈসজ্জিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠানের ফলে ঘুমহীন-নির্ঘুম অবস্থায় দিন-রাত কঠোরতার সাথে ধ্যান করতে গিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই ভান্তের শরীর এমন ভাবে ভেঙ্গে পড়ল স্মৃতি বিহবলের ন্যায় হয়ে গেলেন। সকালে ভিক্ষায় গেলে দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হত। চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসত। সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকত এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল। শরীরের ব্যথা-বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রনা দিনের পর দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। যন্ত্রণায় শরীরের অবস্থা এমন শোচনীয় হল যে, শরীরে কম্পন সৃষ্টি হয়ে সারাক্ষণ দোলতে থাকত। মাথা আর চোখের যন্ত্রণায় সবকিছু অসহ্য লাগত। তখন কে কি বলত, ভান্তে কি শুনতেন, কি দেখতেন কিছুই মনে রাখতে পারতেন না। মুখের রুচি নষ্ট হয়ে খাবার খেতেন নাকি মাটি খেতেন তাও বলতে পারতেন না। তার মধ্যে পৃষ্ঠ শয়ন ব্যতীত দাঁড়ানে-গমনে-উপবেশনে ধ্যান করতে গিয়ে পা দুটি অস্বাভাবিক ভাবে ফুলে গিয়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। তবু ক্ষান্ত না হয়ে ধ্যান-ভাবনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। শীতকালে শীতের আগমনে গভীর রাতে যখন প্রচন্ড কনকনে হাঁড় কাঁপানো শীত পড়ছিল, তখন বলতেন- শীত
তুই পারিস নাকি আমি পারি? এই বলে গায়ের চীবর খুলে ধ্যান করতেন এবং ধ্যানরত অবস্থায় যখন তন্দ্রা-আলস্য আক্রমন করত, তখনও গায়ের চীবর খুলে ফেলতেন। কুয়াশার হিম-শীতল শিশির কণা গাছের পাতায় জমে বৃষ্টির ফোটার মত যখন ভান্তের খালী গায়ের উপর পড়ত। তখন ঠান্ডার প্রকোপের তাড়নায় তন্দ্রা-আলস্য চলে যেত।
বসন্ত শেষে একদিন কালবৈশাখী হানা দিল।
সন্ধ্যা থেকে তুফান শুরু হল। ভান্তে সেগুন গাছের
নীচে ধ্যানমগ্নরত। দমকা হাওয়া বারবার ঝাপটা
দিচ্ছিল। ভান্তের চারপাশে গাছের ডালপালা ধূমড়ে
মুছড়ে ভেঙ্গে পড়তে লাগল। বনের পশু-পাখি ভয়ে অস্থির হয়ে দিকবিদিক ছুটাছুটি করছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি পৃথিবী লন্ডভন্ড হয়ে যাবে। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি ও গুরু গুরু শব্দ সাথে মুহুর মুহুর বজ্রপাতের আঘাতে বোমা-বারুদের মত বনভূমিকে যেন অবিরাম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। সন্ধ্যা নেমে এল এমতাবস্থায় শুরু হল অঝোড় ধারার বৃষ্টি। ভান্তেও ধ্যানাসনে অটল। ধ্যান স্থানটা ছিল পাহাড়ের খাদে এবং নীচু। তাই পাহাড় থেকে প্রবল ধারায় পতিত বৃষ্টির পানি গড়িয়ে ভান্তের শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল। রাতভর চলল কালবৈশাখীর ঝড়-তুফান বজ্রপাতের তান্ডব। ভান্তেও বজ্রকঠিন সংকল্পে অনড়। তাই ক্ষনিকের জন্যেও ধ্যানাসন থেকে চ্যুত না হয়ে, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় রাত পার করছিলেন। গ্রামবাসী ভান্তের জন্য দুশ্চিন্তামনে রাতের প্রহর গুনছিল। তুফানের তান্ডবে অনেকের ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেল। বিশাল বিশাল গাছ উপড়ে ফেলে দিল। এমনি করে সকাল হতেই বৃষ্টি যখন থেমে আসল। ভান্তে ধ্যান ভেঙ্গে চোখ মেলে দেখলেন- ভান্তের পড়নে কাপড়ের উপর কাদামাটি পড়ে কাপড় কর্দমাক্ত হয়ে গেছে এবং গ্রামের কয়েকজন সেবক ভান্তেকে দেখতে গিয়ে সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। কেননা তারা দেখলেন যে, যদিও ভান্তের চারিপাশে ভেঙ্গে পড়া গাছের অনেক ডালপালা এদিকে-সেদিকে পড়ে আছে বটে, তথাপি ভান্তের গায়ে একটি গাছের ডালও পড়েনি। ভান্তের কোনো ক্ষতি ও হয়নি। ভান্তে সম্পূর্ণ অক্ষত আর অচঞ্চল অবস্থায় ধ্যানাসনে বসে আছেন। সাধনা জনিত প্রীতিতে ভান্তের দেহ-মন মুখচ্ছবি যেন উজ্জ্বল ও উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। এভাবে সাধনার তৃতীয় বছরে
এসে ভান্তে অভোকাশিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করলেন।
ছাউনিযুক্ত গৃহ, গুহা, কুঠির, বৃক্ষতল পরিত্যাগ করে
সম্পূর্ণ খোলা আকাশের নীচে রাত-দিন অতিবাহিত
করাই অভোকাশিক ধুতাঙ্গ। দৈর্ঘ্য-দুই হাত, প্রস্থ
দেড় হাত ত্রিপল নিয়ে আসন পাতলেন-শনবনের
মাঝে। সাধনার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দেহ
মনে দৃঢ় বীর্য উৎপন্ন করে আরো কঠোর সংকল্পবদ্ধ
হয়ে সাধনায় রমিত হলেন। শনবনে চক্রমনের (স্মৃতিসহকারে হাঁটার) সময় শনের কচি চারার মাথা ও মরে যাওয়া গোড়াগুলো কাঁটার মত পায়ের তলায় বিধে থাকত। আর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্তে রঞ্জিত হত ভান্তের দুটি পা। তখন অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করতেন। তার মধ্যেও দেহ-মনে ধৈর্য্য-সহ্য-বীর্য পরাক্রমতার বলে বিরামহীন ভাবে সাধনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু বর্ষার আগমনে বিকট শব্দে অজস্র বজ্রপাতে জীবনের শংকা নিয়ে বিরামহীন ঝড়-বৃষ্টি-তুফান-শিলাবৃষ্টির বর্ষণে ও লতা-পাতা পঁচে ভীষণ দুর্গন্ধ আর অগনিত বিষাক্ত আটালী- ওড়লী, জোঁক, মশা-ডাঁশের কামড়ে ভান্তে ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে, অস্বাভাবিক জ্বর-বমি শুরু হল। একদিকে রোগের যন্ত্রণা, একদিকে প্রকৃতির বৈরী প্রতিকুলতার তাড়না, আর একদিকে বিষাক্ত কীট পতঙ্গের কামড়ে অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রণা, আবার অন্যদিকে অচিন্তনীয় ত্যাগময় সাধনা জনিত ব্যথা-বেদনা। সব মিলে নিদারুণ দুঃখ-কষ্টে জীবনটা যেন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল এবং দুর্বল হয়ে চলনে অক্ষম হয়ে পড়লেন। প্রাণটা যেন যায় যায় অবস্থা। এভাবে ম্যালেরিয়া এক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। কিন্তু ডাক্তারের চিকিৎসা ও গ্রামবাসীর সেবা-যত্নে ভান্তে দীর্ঘদিন পর আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলেন। ভান্তে এমন কঠোরতার সাথে ধুতাঙ্গ শীল আচরণ রণ করায়, তাঁর কঠোর ত্যাগময় সাধনার কথা চারিদিকে প্রচার হতে শুরু করল এবং এভাবে মরণ-পণ সংকল্পবদ্ধ হয়ে ধুতাঙ্গ শীল অনুশীলন করতে দেখে জনসাধারণ তাঁকে ‘ধুতাঙ্গ ভান্তে’ নামে সম্বোধন করতে লাগলেন।
পুণ্যছড়ি গমন
এক নাগাড়ে ৩ বছর কঠোর সাধনার পর আরো দুর্গম ও গভীর জঙ্গলের উদ্দেশ্যে ২০০২ খ্রিঃ ৬ নভেম্বর উল্টাছড়ি ত্যাগ করে ভক্ত পুজারীদের কাঁদিয়ে অশ্রুজলে ভাসিয়ে অরুন কান্তি চাকমা ও প্রমোদ চাকমা এই ২ জন সেবক নিয়ে অজানা গন্তব্যের দিকে বেড়িয়ে পড়লেন। শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে কখনো ছড়ার বিশালাকার শিলাপাথর ও পানির উপর দিয়ে, আবার কখনো খুব উঁচু-নীচু পাহাড়ী ঢালু পথ বেয়ে ৩ ঘন্টার পথ ৬ ঘন্টায় অতিক্রম করে কমলছড়ির পুণ্যছড়িস্থ (বদাপাড়া) অতীব লোমহর্ষকর ভয়ানক মহাশ্মশানের বিশাল এক বটবৃক্ষের নীচে গিয়ে স্থির হলেন। সে বৃক্ষের নীচে কলাপাতা বিছিয়ে আসন পেতে ভান্তে অন্যান্য ধুতাঙ্গ শীলের সাথে বৃক্ষমূলিক ও শ্মশানিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করলেন। শ্মশানিক ধুতাঙ্গ মানে- যে স্থানে কমপক্ষে ১২ বছর পর্যন্ত মৃতদেহ পোড়ানো বা পুতে রাখা অথবা ফেলে দেওয়া হয়। সে শ্মশানে সংকল্পবদ্ধ হয়ে শয়নাসন গ্রহণ করাই শ্মশানিক ধুতাঙ্গ। আবারো শুরু হল দুঃখ মুক্তির যুদ্ধ। দিনের বেলায় কখনো শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট ছড়ার শিলা পাথরের উপর, কখনো পাশের বাঁশবনে, আবার কখনো বা শনবনে বসে ধ্যান করতেন। আর রাত্রে বটবৃক্ষের নীচে বসে বিরামহীনভাবে ধ্যান-ভাবনার মাধ্যমে নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধানার উচ্চমার্গে নিয়ে যেতে লাগলেন। পাহাড়ী অসংখ্য বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ, মশা-ডাঁশ-আটালী-ওড়লীর কামড়ে শারীরিক জ্বালা-যন্ত্রণা এবং রাতে অমনুষ্য প্রেতাত্মাদের অস্বাভাবিক চিৎকারের শব্দ ভান্তেকে যেন দুশ্চিন্তা গ্রন্থ করে তুলল। কিন্তু ভান্তে নিজেকে সামলিয়ে স্থির রেখে মরণানুস্মৃতির মাধ্যমে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে অপার মৈত্রী ভাবনায় নিবিষ্ট হলেন। যার ফলে ভান্তের দেহ মনে অসাধারণ এক প্রীতি ও আনন্দের স্ফুরণ অনুভব হল। ভান্তের মৈত্রীর কাছে প্রেতাত্মারা দমিত হয়ে উৎপাত বন্ধ করে দিল। কিন্তু ঘোর বর্ষাকাল সমাগত ঝড়-বৃষ্টি-তুফানের সাথে বিকট শব্দে মুহুর্মুহু বজ্রপাত শুরু হল। বর্ষার বিরামহীণ বর্ষণ ও অজস্র মশার কামড়ে ভান্তে ম্যালেরিয়া জনিত কঠিন জ্বর ও বমিতে আক্রান্ত হলেন। কয়েক দিনেই শরীর শক্তিহীন হয়ে দুর্বল হয়ে পড়লেন। শরীর চলে না তবু মনে শক্তি সঞ্চয় করে বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতের মধ্যে মৃত্যুর আশঙ্কা উপেক্ষা করে ভিক্ষায় গেলেন। আহার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে বমি করে বিহবল হয়ে বৃষ্টিতে বমির পাশে পড়ে রইলেন। বটবৃক্ষের তলে ৮ মাস সাধনার পর বর্ষাবাস উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে জ্বর নিয়ে দুর্বল শরীরে ভেজা কাপড়ে কুঠিরে প্রবেশ করেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইলেন। ৪/৫ ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে দেখলেন- পুরো শরীর মশার দখলে চলে গিয়ে তাদের খাদ্যে পরিণত হল। পরে গ্রামবাসীর সেবা শুশ্রূষায় ভান্তে আরোগ্য লাভ করলেন।
চংড়াছড়ি গমন
এবার পুণ্যছড়ি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কয়েকজন সেবক নিয়ে ২০০৩ খ্রি: ২৭শে অক্টোবর আবারো অজানা গন্তব্যের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। ক্লান্ত শরীরে দুর্গম ও বিশাল উচু-নীচু পাহাড়ী পথ আর ছড়ার পানি ভেঙ্গে ৩ ঘন্টার রাস্তা দীর্ঘ ৭ ঘন্টায় হেঁটে সন্ধ্যাবেলায় দীঘিনালার মেরুংস্থ চংড়াছড়ি বড়াদম গ্রামে উপস্থিত হলেন। রাতটা গ্রামের অনতিদুরে সেগুন বাগানে কাটিয়ে সকালে সাধারণের অগমনীয় আর এক ভয়ংকর জঙ্গলে প্রবেশ করে বাঁশ বাগানের পাশে একটি কদমফুল গাছকে আশ্রয় করে বৃক্ষমূলিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করে পুন: সাধানায় নিমগ্ন হলেন। পরদিন পিন্ডচারণে (ভিক্ষায়) যাওয়ার সময় পথের ধারে একটি চীবর (কাপড়) পড়ে থাকতে দেখে তা কুড়িয়ে নিয়ে পাংশুকুলিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করেন। পাংশুকুলিক মানে- শ্মশান অথবা রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া সাদা বস্ত্র থেকে চীবর সেলাই করে অথবা পথের ধারে পড়ে থাকা সেলাইকৃত চীবর কুড়িয়ে নিয়ে পরিধান করাই পাংশুকুলিক ধুতাঙ্গ। পাংশুকুলিক অধিষ্ঠানের মাধ্যমে ভান্তে ১৩ প্রকার ধুতাঙ্গ পরিপূর্ণ করেন এবং আরো কঠিন সংকল্প নিয়ে অমানুষিক ত্যাগ অনুশীলনে সাধনায় নিমজ্জিত হলেন। কিন্তু তিনি যতই সাধনার উচ্চমার্গে অবগাহন করতে লাগলেন ততই যেন বার বার মৃত্যুর সম্মুখীন হচ্ছিলেন। একদিন রাতের আকাশের তারার আলোতে ছড়ার পাশে পাহাড়ের সরুপথ (খাদের কিনারা) ধরে চংক্রমন (ধ্যান সহকারে হাঁটা) করছিলেন। এমন সময় দেবপুত্র মার (অপদেবতা) খাঁড়া পাহাড়ের উপর থেকে ধাক্কা মেরে ভান্তেকে প্রায় ৭০ ফুট নীচে গভীর খাদে ফেলে দেয়। কিন্তু মাটিতে পড়ার পূর্বেই এক সৎ দেবতা ভান্তেকে ধরে ফেলে কোলে নিয়ে রক্ষা করে। তবে পায়ে সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। ২০০৪ খ্রিঃ ১৪ নভেম্বর পুন: অভোকাশিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করে খোলা আকাশের নীচে ছড়ার পাশে সাধনায় আত্মনিয়োগ করলেন। ৪ ডিসেম্বর গোধূলী লগ্ন সন্ধ্যায়, ভান্তে ধীর পদক্ষেপে স্মৃতিসহকারে চংক্রমন করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ এক বিষধর চেঁওড়া (লম্বা প্রায় ১০ ইঞ্চি, মোটা প্রায় ১ ইঞ্চি) ভান্তের পায়ে দংশন করে বসল। সাথে সাথে বিষক্রিয়ায় পুরো শরীরে অসহনীয় যন্ত্রণা আর কাঁপন শুরু হল। দংশিত স্থানে কালো হয়ে পা অস্বাভাবিক হারে ফুলে গেল। বিষের দুঃসহ যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আর্তনাদে নির্ঘুম রাত পার করলেন। সকালে পিন্ডচারণে না যাওয়ায় লোকজন গিয়ে দেখলেন- বিষক্রিয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে ভান্তে লুটিয়ে পড়ে আছেন। তখন দ্রুত ডাক্তার এনে দংশনের প্রায় ১৫ ঘন্টা পর শরীরে ঔষধ ও ইনজেকশন পুষ করার পর ধীরে ধীরে সেরে উঠেন। ২০০৫ খ্রিঃ বৈশাখী পূর্ণিমার ৮/১০ দিন পর রাতের ঘোর অন্ধকারে দৃঢ়বীর্য সহকারে চংক্রমন করছিলেন। চংক্রমন শেষে বাতি জ্বালানোর জন্য যাচ্ছিলেন। যাবার সময় পায়ে ঠান্ডা আর পিচ্ছিল কি যেন স্পর্শ অনুভব হল। তৎক্ষনাত ভান্তের সারা শরীর চমকে ও শিহরে উঠল। দ্রুত বাতি জ্বালালেন। দেখলেন- সবুজ রঙের বিশাল এক কোবড়া সাপ ফণা ধরে বসে আছে। সাপটি ভান্তেকে দংশন করতে চেয়েছিল। ভান্তের পায়ের সঙ্গে সাপটির মুখ ঘেঁষে যাওয়ায় ঠান্ডা ও পিচ্ছিল অনুভব হয়েছিল। সাপের দংশন থেকে রক্ষা পেলেও দংশন করতে চাওয়া স্থানে ছোট ছোট দাগ ও সাপের মুখের লালা লেগে থেকে ছিল। পরদিন সকালে গ্রামবাসী ডাক্তার এনে ইনজেকশন ও ঔষুধ প্রয়োগ করে ভান্তেকে আশংকা মুক্ত করেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমার পূর্বে বর্ষাবাস উপলক্ষে ভান্তে কুঠিরে প্রবেশ করলেন এবং বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করলেন। অধিষ্ঠানের এক ঘন্টা পর প্রচন্ড এক ভূমিকম্প হল। ২০০৬ খ্রি: অপরিসীম ও অচিন্তনীয় ত্যাগময় কর্ম সম্পাদন করে তিনি অধিষ্ঠিত কঠোর সাধনার সপ্তম বছরে পা রাখলেন। অমানুষিক ত্যাগ অনুশীলন জনিত কারণে ভান্তের দেহ-অত্যাধিক নাজুক ও মৃহ্যমান হয়ে পড়ে। যার দরুণ কঠোর সংকল্পের ৭ম বছরের সাধনা কুঠিরেই সম্পাদনে ব্রতী হলেন। কিন্তু ক্ষুধা-পিপাসা-তৃষ্ণা নামক মারকে পরাভূত করার প্রত্যয়ে আর এক বজ্রকঠিন সংকল্প গ্রহণ করলেন। সুদীর্ঘ সাড়ে তিন মাস (১০৬ দিন) অনাহারী থাকার অধিষ্ঠান নিয়ে উপোস থাকা শুরু করলেন। উক্ত ১০৬ দিনের মধ্যে ৭ দিন সম্পূর্ণ এক ফোটা পানি পর্যন্ত মুখে দেননি। বাকী ৯৯ দিন শুধুমাত্র বৈকালীক পানীয় গ্রহণ করেও কঠোর ধ্যান-সমাধিতে রত থাকেন। এরপর ২০০৮ খ্রি: আবারো এক নাগাড়ে ৯২ দিন উপোস থেকেও ধ্যান সমাধিতে রত থেকে নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনা ও ত্যাগময় জগতের অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান। এছাড়াও পরবর্তীতে তিনি আরো অনেক বার অনাহারী থেকে উপোস ছিলেন। যেমন- ২০১২ খ্রি: উল্টাছড়িতে ৩৪ দিন। ২০১৪ খ্রিঃ আবুরখীলস্থ ধুতাঙ্গ কুঠিরে ৭৬ দিন। ২০১৫ খ্রি: ধুতাঙ্গ কুঠিরে ৪২ দিন। ২০১৬ খ্রি: ধুতাঙ্গ কুঠিরে একাক্রমে ১১৬ দিন। ২০২১ খ্রিঃ ধুতাঙ্গ কুঠিরে একটানা ৮৪ দিন কোনো প্রকার দানা জাতীয় খাবার না খেয়ে শুধু পানীয় গ্রহণ করেই উপোস ছিলেন। চংড়াছড়িতে ১০৬ দিন ও ৯২ দিন অনাহারী থেকে অতীব কঠোরতার সাথে ধ্যান করতে গিয়ে ভান্তের শরীর ভেঙ্গে এমন শোচনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, শরীর শুকিয়ে রুগ্ন হয়ে কাষ্ঠবত হয়ে গেল। দেহের প্রতিটি হাঁড় যেন এক এক করে গণনা করা যেত। শরীরের বর্ণ বিবর্ণ হয়ে সম্পূর্ণ কৃষ্ণবর্ণে পরিণত হল। তখন ধ্যান স্থান থেকে পায়খানা-প্রস্রাবে যাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেললেন। যার ফলে শিষ্য ভদন্ত আর্য্যরত্ন স্থবির ভান্তেকে কোলে করে টয়লেটে নিয়ে যেতেন। তখন ভান্তে নিজের পেটে হাত দিলে মনে হত যেন, এই বুঝি পিঠ ধরেছি। পিঠে হাত দিলে মনে হত যেন, এই বুঝি পেট ধরেছি। অর্থাৎ এক কথায় পেট আর পিঠ লেগে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এমনি করে তাঁর ত্যাগময় সীমা এমন চরমে পৌঁছেছিল যে,ত্যাগ করতে করতে প্রাণটাই ছিল কেবল ত্যাগের অবশিষ্ট। তবু অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত বজ্রকঠিন সংকল্প থেকে চুল পরিমান চ্যুত না হয়ে
মরণ-পণ চেষ্টায় ব্রতী হতে, এবার চংড়াছড়ি ত্যাগ করে অগনিত ভক্ত-পূজারীকে কাঁদিয়ে অশ্রুজলে সিক্তকরে আবারো বেড়িয়ে পড়লেন ধ্যান উপযোগী অজানা অরণ্যের খোঁজে।
ধুতাঙ্গ পাহাড়ে গমন
২৬ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ খ্রিঃ কয়েকজন সেবক সহ রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাই থানাধীন চিৎমরম ঘাট
দিয়ে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে দক্ষিণের রাস্তা ধরে,
প্রায় ৮ কিলোমিটার পাহাড়ী পথ পাড়ি দিয়ে
লোকালয় থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে অনেক খাড়া ও উচু দুর্গম ধুতাঙ্গ পাহাড়ের চুড়ায় উঠে পড়লেন এবং অন্যান্য ধুতাঙ্গ শীলের সঙ্গে অভোকাশিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করে, খোলা আকাশের নীচে মুক্তির প্রবল বাসনা বুকে ধারণ করে সাধনায় নিবিষ্ট হলেন। কিন্তু দিন কয়েক যেতেই মারের (অপদেবতার) চক্রান্তে পড়ে মদ্যপায়ী এক ব্যক্তি ধারালো দাঁ আর কান্ঠা নিয়ে ভান্তেকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হল। কিন্তু ধুতাঙ্গ ভান্তে ছিলেন- সিংহের ন্যায় নির্ভীক, শীলাময় পর্বতের ন্যায় স্থির-অকম্পিত। মদমত্ত ও ক্রোধান্বিত ঐ ব্যক্তিকে অপার মহিমায় মৈত্রী বর্ষণ করে, তাকে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ করলেন এবং ভান্তে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- দাঁ-কান্ঠা কেন এনেছ? সে বলল- তোমাকে হত্যা করার জন্য। আমি গ্রামে বলে এসেছি- তোমাকে হত্যা করে তবেই যাব। কান্ঠা এনেছি- দুর থেকে মারার জন্য। আর দাঁ এনেছি- কাছে আসলে দাঁ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার জন্য। পরক্ষণে ভান্তের অপার মৈত্রীগুণে ও শীলতেজের প্রভাবে বশীভূত হয়ে বলতে লাগল- তুমি এখানে থাক, ধ্যান কর। কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু এত দুর্গমে তুমি কিভাবে থাকবে? আর পিন্ড (খাবার) বা কে দেবে? তুমি এখানে মরবে মরবে। আবার বলল- তোমাকে কেউ খাবার না দিলে আমিই দেব। আমিই তোমাকে সেবা করব। এই বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে গেল। বন্য হাতির পাল ভান্তের ধ্যান স্থানের চারপাশে দল বেধে বিচরণ করত। এছাড়াও ভাল্লুক, দাঁতাল বন্য শুকর, হরিণ, শিংযুক্ত চামড়ী ছাগল, বানর, হনুমান সহ বড় বড় বিষধর সাপের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র ছিল। তাদের মাঝেই ভান্তে বনরাজ সিংহের ন্যায় নির্ভয়ে সাধনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হাতির পাল প্রায়শই ভান্তের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করলেও কখনো ভান্তের কাছেও যেতনা, কোনো ক্ষতি-ও করত না। ভান্তে কখনো হাঁড় কাঁপানো কণকণে শীতের তাড়না, কখনো প্রচন্ড খড়া রোদের তাপদাহ, আবার কখনো বর্ষার বিরামহীন ঝড়-বৃষ্টি-তুফান শিলাবৃষ্টি ও বিকট শব্দে মুহুর্মুহু বজ্রপাতের মধ্যে প্রাণ সংহারের আশংকা নিয়ে ধ্যান-সাধনা করতে গিয়ে, সাপ যেমন নিজের পুরনো চামড়া পাল্টিয়ে নতুন চামড়া ধারণ করে। ঠিক একই প্রকারে ভান্তের শরীরের চামড়াও পাল্টে যায়। শুধু একবার নয়, চার-পাঁচ বার ভান্তের শরীরের চামড়া পাল্টে গিয়েছিল। ঘোর বর্ষা নেমে এল, অবিরাম বৃষ্টিতে ভিজে, মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া জনিত জ্বর-বমি কঠিন রোগে আক্রান্ত হলেন। কিছুই খেতে পারছিলেন না, খেলেই বমি হচ্ছিল। বমি করে শক্তিহীন হয়ে বমির পাশে পড়ে থাকতেন। এভাবে একদিকে ম্যালেরিয়া জনিত কম্পন দিয়ে ১০৪/১০৫ জ্বরের দুঃসহ যন্ত্রণা, একদিকে বিরামহীন বৃষ্টি বর্ষনের তাড়না, আবার অন্যদিকে বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ, মশা-ডাঁশ, আটালী- ওড়লীর কামড়ের যন্ত্রণায় আবারো ভান্তের প্রাণ সংকটাপ্ন হয়ে পড়ল। তখন মনে হল এবার বুঝি আর রক্ষা নেই। মৃত্যু যেন অনিবার্য। শরীর শুকিয়ে গলার কন্ঠনালী মাংস-চামড়া ভেদ করে দেখা দিল। মৃত্যুসম যন্ত্রণা নিয়ে সারাক্ষণ ছটফট করতেন। পাশে কেউ নেই তবু পিষ্ঠ শয়ন না করে সংকল্পে অনড় থেকে বসে রাত-দিন অতিবাহিত করছিলেন। অতীব দুর্গম হওয়ায় ডাক্তার যেতে চাইত না। তাই খবর পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে কোনো দিন ভান্তের মামা ডা: মাদল বড়ুয়া, ডাঃ দীলিপ বড়ুয়া, কোনো দিন তাঁর বড় ভাই ডা: প্রকাশ বড়ুয়া। আবার কোনো দিন ফার্মাসিষ্ট মাসীতো ভাই জনি বড়ুয়া পালাক্রমে গিয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করে, ঔষধ-ইনজেকশন-সেলাইন পুষ করে চিকিৎসা করতেন। ভান্তে যখন চলনে অক্ষম হয়ে পায়খানা-প্রস্রাবে যেতে পারছিলেন না। তখন জনি বড়ুয়া ভান্তেকে কোলে করে টয়লেটে নিয়ে যেতেন। এছাড়াও বিনাজুরী গ্রামের পলাশ বড়ুয়া (বর্তমানে শিষ্য ভদন্ত শান্তইন্দ্রিয় স্থবির), মহামুনি গ্রামের রুবেল মুৎসুদ্দী সহ অনেকে সেখানে অবস্থান করে দীর্ঘদিন যাবত ভান্তেকে সেবা-যত্ন দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। কিন্তু মুশকিল ছিল একটি- ভান্তেকে সেলাইন পুষ করে বেশিক্ষণ যেতে পারত না, সে সেলাইন খুলে ফেলে দিতেন। যা বর্তমানেও বজায় আছে। এবারও যেন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন এবং আরোগ্য লাভ করে আবারো গভীর ধ্যানে মনোযোগী হলেন। দীর্ঘ ৯ বছর পর এবার অভীষ্ট লক্ষ্য ভেদ করতে সক্ষম হলেন। আধ্যাত্মিক জগতে ধ্যান মার্গের চরম সীমা অতিক্রম করে, গন্তব্যের শেষ ঠিকানায় (স্টেশনে) আরোহন করলেন। জন্ম-জন্মান্তর, কল্প-কল্পান্তরের পারমী হল পূর্ণ। সাথে সাথে পৃথিবী কম্পিত করে লোমহর্ষকর এক ভূমিকম্প হল। ধুতাঙ্গ ভান্তে লোভ-দ্বেষ-মোহ, হিংসা, অহংকার, মান-অভিমান, অবিদ্যা-তৃষ্ণা, সমস্ত মনের ময়লা-আবর্জনা, বিষয়-বাসনা, আসক্তি-সংযোজন গুলোকে সমূলে উৎপাটিত করে, জন্ম-জরা-ব্যাধি-মৃত্যু নামক দুঃখকে পদদলিত করে, অজর-অমর নির্বাণ সাক্ষাৎ করে প্রতিসম্ভিদাসহ ষড়াভিজ্ঞ অরহত ‘অনুবুদ্ধ’
রুপে ধরাধামে আবির্ভূত হলেন। বিশ্ব পেল চন্দ্রসম
সাধনসিদ্ধ, বিমল-বিশুদ্ধ এক আধ্যাত্মিক
মহাপুণ্যপুরুষ। ভান্তের আধ্যাত্মিক সাধনার করণীয়
কর্তব্য সমাপ্ত হল। তথাপি সাধনার ১২ বছর পূর্ণ
করার লক্ষ্যে আবারো স্থান পরিবর্তন করে আর এক
অজানা নতুন সাধনার উপযোগী স্থানের দিকে যাত্রা
করলেন।
হরিণছড়াস্থ ভাঙ্গামুড়া
১৬ জানুয়ারী ২০১০ খ্রিঃ পূর্ব দিকের পাহাড়ী আঁকাবাঁকা আর উচু-নীচু পথ ধরে দীর্ঘ ৩ ঘন্টায় হেঁটে জনমানব শূন্য লোকালয় থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে অতীব দুর্গম ভাঙ্গামুড়া পাহাড়ের চুড়ায় উঠে অবস্থান নিলেন এবং বৃক্ষমূলিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করে ধ্যান শুরু করলেন। শীতের তীব্র শৈত্য প্রবাহ, কাল বৈশাখীর প্রচন্ড বেগে ঝড়-বৃষ্টি তুফান-বজ্রপাত আর বিষাক্ত মশা-পোকা কীটপতঙ্গের কামড়ের যন্ত্রণাকে বীর্য পরাক্রমতার সাথে ধৈর্য-সহ্য করে ধ্যান-সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন রাখলেন। অব্যাহতভাবে চলছিল ভান্তের সাধনা। কিন্তু বর্ষার প্রবল বৃষ্টি আর মশার কামড়ের বিষক্রিয়ার আবারো ভান্তে জটিল ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হলেন। এবার ভান্তে অধিষ্ঠান করলেন- মরলে মরব কিন্তু এক সপ্তাহ পর্যন্ত কোনো ঔষধ খাব না। কোনো ইনজেকশন-সেলাইন শরীরে পুষ করবেন না। দেখা গেল, অধিষ্ঠানের এক সপ্তাহ পরেই কোনো প্রকার ঔষধ, ইনজেকশন-সেলাইন ছাড়াই শুধু সেবকদের সেবা নিয়েই ভান্তে আরোগ্য লাভ করলেন। এরপর থেকে আজ অবধি আর কখনো ভান্তে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হননি।
উল্টাছড়ি গমন
১৭ নভেম্বর ২০১০ খ্রিঃ পুন: নিজের প্রথম ধ্যান স্থান
উল্টাছড়ির উদ্দেশ্যে গমন করলেন এবং বিশাল একটি কোনাক গাছের নীচে অবস্থান নিয়ে বৃক্ষমূলিক ধুতাঙ্গ অধিষ্ঠান করে ধ্যানরত ২০১২ খ্রি: এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে অনাহারী অধিষ্ঠান নিয়ে ধ্যান করছিলেন। ঐ অবস্থায় এপ্রিলের শেষের দিকে ভান্তে আবারো মৃত্যুর মুখোমুখী হলেন। সেদিন সকালে ধ্যান স্থানে বৃক্ষতলে ভান্তে শিষ্যসংঘকে উপদেশ দিচ্ছিলেন। কিন্তু শিষ্যদের হঠাৎ বলে উঠলেন- তোমরা কুঠিরে – চলে যাও। শিষ্যরা কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে ভান্তের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভান্তে আবারো বললেন- তোমরা যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও। এখনি এই স্থান ত্যাগ করে কুঠিরে চলে যাও। ভান্তের নির্দেশে শিষ্যরা দেরি না করে প্রায় ১৫০০ ফুট দূরে গিয়ে কুঠিরে প্রবেশ করলেন। আর সাথে সাথে আগুনের গোলা সদৃশ আলোয় আলোকিত করে বিকট শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত করে, এক বজ্রপাত পড়ল ভান্তের অধিষ্ঠিত ধ্যানরত কোনাক গাছের উপর। অগ্নিস্ফুলিঙ্গে সে জীবন্ত বৃক্ষের শাখা-প্রশাখা পুড়ে কয়লায় পরিনত হল। যে বৃক্ষে সোলারের প্যানেল বাধা ছিল। সেটি কুড়াল দিয়ে কোপ দিলে যেভাবে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সেভাবে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। ভান্তের ধ্যান আসন ঘিরে দেওয়া ত্রিপল টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। শিষ্যরা তড়িৎ গতিতে ভান্তের কাছে ছুটে গেলেন। দেখলেন- ভান্তে সম্পূর্ণ অক্ষত এবং স্বাভাবিক। শান্ত-দান্ত, নির্ভীক, অচঞ্চল আর সুস্থির। শিষ্যদের হাস্যমুখে বললেন- ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমার কোনো ক্ষতি হয়নি। কেবল গাছটার ক্ষতি হয়েছে। এবারও যেন ভান্তে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন। এভাবে তিনি দীর্ঘ ১২ বছরের কঠোর সাধনা শেষ করে ১ জুন ২০১২ খ্রিঃ কুঠিরে প্রবেশ করেন। উল্লেখ্য যে, তিনি ১২ বছর যাবত সাধনারত অবস্থায় কঠোর সাধনার ৭ম বছর পূর্ণ হওয়ার পর ২৩ মার্চ ২০০৭ খ্রিঃ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ খ্রিঃ পর্যন্ত এবং পুন: ১৯ নভেম্বর ২০১০ খ্রিঃ থেকে ৩০ মার্চ ২০১২ খ্রিঃ পর্যন্ত হাজারো দুঃখ-কষ্ঠের মাঝে সাধনার পাশাপাশি বৈরী – প্রতিকুলতা আর অপরিসীম শারীরিক কষ্ট স্বীকার করে চাল বিহীন খোলা গাড়িতে চেঁপে ঝড়ে ভিজে, রোদে শুকিয়ে দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে গৌতম – বুদ্ধের আবিষ্কৃত দুঃখ মুক্তির একমাত্র নির্বাণ প্রদায়ী ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ খ্রিঃ থেকে আজ অবধি দেশ-বিদেশ বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর ধর্ম প্রচারের সংখ্যা দেড় শতাধিকের অধিক। আর সেই সূত্র ধরে ২০১৩ খ্রিঃ ৩ জানুয়ারী ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধ জনসাধারণ খাগড়াছড়িস্থ উল্টাছড়ি আর্য্যপুরুষ শীলানন্দ ধর্মোদয় বিহার থেকে, ভান্তেকে হেলিকপ্টার যোগে রাউজান উপজেলার আবুরখীল গ্রামস্থ ‘ধুতাঙ্গ কুঠিরে’ আনা হয় এবং ৪ জানুয়ারী ২০১৩ খ্রিঃ ধুতাঙ্গ ভান্তে কর্তৃক উপমহাদেশে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ঢাকা-চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য অঞ্চল সহ, কক্সবাজার মিলে প্রায় ১,২০০ (বারশত) জন বৌদ্ধ কুলপুত্রকে শ্রামণ্য ধর্মে প্রব্রজ্যা প্রদান ও ৫ জানুয়ারী ২০১৩ খ্রিঃ ভিক্ষু-শ্রামণ, দায়ক-দায়িকা (জনসাধারণ) মিলে প্রায় ৫০,০০০ (পঞ্চশ হাজার) এর অধিক মানুষের – সমাগমের মাঝে, ভান্তে দুঃখ মুক্তির উপায় সম্বলিত মহাসতিপটঠানসূত্র পাঠ ও মর্মার্থ দেশনা করেন। যা বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ইতিহাসে বিরল এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। পুণরায়
উল্টাছড়িতে ২০১৪ খ্রি: ঢাকা-চট্টগ্রাম, তিন পার্বত্য
অঞ্চলের ৪০০ (চারশত) জনের অধিক বৌদ্ধ
কুলপুত্রকে ধুতাঙ্গ ভান্তে কর্তৃক প্রব্রজ্যা প্রদান করে
তাদের বুদ্ধের বুদ্ধের মূলনীতি আর্দশ শিক্ষার পাশাপাশি ৭ দিন ব্যাপী ধ্যান অনুশীলন করানো হয়। সেই থেকে ধুতাঙ্গ ভান্তের সুনাম-সুখ্যাতি, প্রচার-প্রসার – পরিচয়-পরিচিতি বাংলাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বর্হিবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে ভারত, মায়ানমার, জাপান, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড উল্লেখ্যযোগ্য। যার ফলে বিভিন্ন দেশে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ভান্তেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে প্রার্থনা করার দরুণ- ভান্তে ভিয়েতনামের ভক্ত পূজারীদের প্রার্থনা অনুমোদন করেন। তাই ২০১৭ খ্রিঃ একবার এবং ২০১৯ খ্রিঃ একবার মোট দুইবার উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ধর্ম প্রচারের জন্য ধুতাঙ্গ ভান্তেকে চট্টগ্রামের শাহ্ আমানত বিমান বন্দর থেকে একান্তভাবে চার্টার বিমান যোগে ভিয়েতনামে – নিয়ে যান এবং সেখানে তিনি দীর্ঘ পাঁচ মাসের
অধিক কালব্যাপী বৌদ্ধধর্ম প্রচারের পাশাপাশি
ভিয়েতনামের জাতীয় পতাকার পাশে বাংলাদেশের
জাতীয় পতাকা উড্ডীন করে দুই দেশের
সৌভাতৃত্বের বন্ধন স্থাপনসহ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি
বর্ধিত করেন। তখন ভিয়েতনামের জনসাধারণ সে
দেশে ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে পাহাড়ী মনোরম
পরিবেশে বিভিন্ন স্থাপনা সহকারে পঁয়ত্রিশ একরের
বিশাল এক প্রতিষ্ঠান ভান্তেকে দান করেন। ভান্তে
সে প্রতিষ্ঠানের নাম রাখলেন- ভিয়েত-বাংলা
ইন্টারন্যাশনাল মেডিটেশন সেন্টার। বিদেশ ও
দেশের পার্বত্য অঞ্চল ও সমতল মিলে তাঁর
প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৩৩টি এবং তাঁর দীক্ষিত ৬০ জন ভিক্ষু শ্রামণের মধ্যে ২০ জন তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা, নীতি-আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন দুর্গম পাহাড়ে তাঁর মতো ৫ বছর থেকে ১১ বছর ধরে ধুতাঙ্গ শীল নিয়ে বৃক্ষতলে, খোলা আকাশের নীচে, শ্মশানে, ছড়ার পাথরে, শনবনে বিভিন্ন ভাবে ধ্যান সাধনায় রমিত আছেন। দেশের বিভিন্ন গ্রাম-অঞ্চলে তাঁর ৩৮টি সংগঠন ও আড়াই শতাধিক গ্রামে ভক্ত পূজারী রয়েছে।
Leave a Reply