বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হিসেবে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী যেমন চাকমা, মারমা, ম্রো, ত্রিপুরা, রাখাইন এবং বড়ুয়া সম্প্রদায় বহুদিন ধরেই ধর্ম ও দেশপ্রেমে নিবেদিত। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাদের অনেক মিল থাকা সত্ত্বেও, এই সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান এবং বিশেষ করে বিবাহ বন্ধনে বাধা রয়েছে। এ কারণে তাদের মধ্যে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে, যা বৌদ্ধ ধর্মের মূল চেতনার বিরুদ্ধ।
প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আছে। আদিবাসী ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের ভাষা, উৎসব, সামাজিক নিয়ম ও বিবাহ প্রথায় পার্থক্য থাকায় অনেক সময় তারা একে অপরকে ‘অপরিচিত’ মনে করে। এতে পারস্পরিক বিবাহে পরিবারের পক্ষ থেকে বাধা সৃষ্টি হয়। পরিচয় রক্ষার নামে এ ধরনের ভিন্নতাকে অতিরিক্ত বড় করে তোলা হয়, যা বাস্তবে অপ্রয়োজনীয় বিভাজন।
তাছাড়া, দীর্ঘদিন নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার ফলে একে অপরের সংস্কৃতি বুঝতে ও গ্রহণ করতে অনীহা তৈরি হয়েছে। এই মনোভাব সমাজে অবিশ্বাস ও দূরত্ব বাড়ায়। যার ফলে একাত্মবোধের পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতা বাড়ে, যা সমাজকে দুর্বল করে।
অন্যদিকে, বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা যেমন মৈত্রী, করুণা ও সমতার উপর ভিত্তি করে গড়া, সেই শিক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক রয়েছে। বৌদ্ধ শাস্ত্রে বলা আছে, “সবাই মিলেমিশে এক হও, কারো প্রতি ঘৃণা রাখিও না।” কিন্তু আদিবাসী ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক বাধার কারণে পারস্পরিক বিবাহ গড়ে ওঠে না। পরিবার-সমাজ অনেক সময় এ ধরনের সম্পর্ককে স্বীকার করতে চায় না, কারণ তারা ভয়ে থাকে যে এতে তাদের সংস্কৃতি ও পরিচয় নষ্ট হবে।
পরিচয়ের ভীতি ও নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার আশঙ্কাও বিচ্ছিন্নতার বড় কারণ। যদিও সংস্কৃতি সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হতে পারে, তবুও এ ভীতি পারস্পরিক বন্ধন রক্ষা করতে বাধা দেয়।
এইসব বিচ্ছিন্নতা শুধু সমাজের ঐক্যের পথে বাধা নয়, বরং একাত্মবোধ ও সামাজিক শক্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। পারস্পরিক সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অভাবে সমাজ বিভাজিত হয় এবং অবিশ্বাস বাড়ে, যা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ক্ষতিকর।
আমাদের ভাবতে হবে, আমরা কি নিজেরাই নিজেদের দুর্বল করে ফেলছি? বৌদ্ধ ধর্ম শেখায় করুণা, মৈত্রী ও সমতা। যদি আমরা নিজেদের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে গ্রহণ করতে পারি, তাহলে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
বৌদ্ধ বানী বলে— “যে যার দৃষ্টি পরিবর্তন করে, সে নিজের অন্তর পরিবর্তন করে,” এবং “সত্যিকার শান্তি আসে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও মৈত্রী থেকে।” এই মানসিকতা বদলালে আমরা দূরত্ব কমিয়ে মিলন ঘটাতে পারবো।
বাংলাদেশে আদিবাসী ও বড়ুয়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য, সামাজিক ভীতি ও অবিশ্বাসের কারণে বিবাহ ও আদানপ্রদানে বাধা রয়েছে। কিন্তু এই বিভাজন ভেঙে ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়াই আজকের প্রয়োজন। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়া বাড়িয়ে বৌদ্ধ ধর্মের চেতনায় একসাথে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক- তাপস বড়ুয়া, এম এ।
সাংবাদিক, দ্যা ফাইনেন্সিয়াল পোস্ট
Leave a Reply