তাপস বড়ুয়া, চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম ঐশ্বর্য সাঙ্গু নদী। এটি শুধু একটি জলধারা নয়, বরং এ অঞ্চলের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা এবং প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর তীরবর্তী শীলঘাটা গ্রাম এই নদীর সৌন্দর্য ও আশীর্বাদে বিকশিত এক নৈসর্গিক জনপদ। শীলঘাটা গ্রামের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় সাঙ্গু নদীর স্রোত যেন প্রাণের ছন্দ তুলে ধরে। এই নদী শুধু ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং স্থানীয় মানুষের হৃদয়ে এক ভালোবাসার নাম।
শীলঘাটা গ্রাম সাঙ্গু নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক মনোরম জনপদ। পাহাড় ও নদীর মিলনে এই গ্রাম যেন প্রকৃতির এক নিখুঁত চিত্রকলা। এখানকার মানুষ প্রতিদিন নদীর স্নিগ্ধ ছোঁয়া অনুভব করে, এর জলেই তাদের জীবনযাত্রার স্পন্দন। ভোরবেলা নদীর কুয়াশাচ্ছন্ন তীরে হাঁটতে গেলে এক অপার্থিব অনুভূতি হয়। পাখির কলতান আর মৃদু বাতাসের দোলায় নদীর ধারে বসে থাকা যেন এক পরম শান্তির অনুভূতি এনে দেয়।
শীলঘাটার মানুষের কাছে সাঙ্গু নদী শুধু পানি প্রবাহ নয়, বরং এক নির্ভরতার প্রতীক, এক ভালোবাসার নাম। সকালবেলা শিশুরা নদীর তীরে খেলে, জেলেরা মাছ ধরার জন্য নৌকা ভাসায়, নারীরা নদীর স্বচ্ছ জলে বাসন মাজে, আর কৃষকরা নদীর পলিমাটিতে সোনালি ফসল ফলায়। এমনকি গ্রামের বয়স্করাও নদীর পাড়ে বসে অতীতের গল্প শোনায়, আর নতুন প্রজন্মকে শেখায় নদীর সঙ্গে জীবনের গভীর সম্পর্কের কথা।
শীলঘাটা গ্রামের কৃষিজীবী মানুষের জন্য সাঙ্গু নদী আশীর্বাদস্বরূপ। এই নদীর পলিমাটি জমিকে উর্বর করে তোলে, ফলে ধান, শাকসবজি, ও অন্যান্য ফসল চাষে সুবিধা হয়। নদী থেকে সেচের পানি সংগ্রহ করেও কৃষিকাজ করা হয়।
শুধু কৃষিকাজ নয়, শীলঘাটা গ্রামের মানুষ সাঙ্গু নদীকে কেন্দ্র করেই জীবিকা নির্বাহ করে। জেলেরা প্রতিদিন নদীতে মাছ ধরে, যা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয়।
শীলঘাটা গ্রামের মানুষ সাঙ্গু নদীকে কেবলমাত্র এক জলধারা হিসেবে দেখে না, তারা এটি অনুভব করে, ভালোবাসে। বর্ষাকালে যখন নদীর স্রোত তীব্র হয়ে ওঠে, তখন শীলঘাটার মানুষ প্রকৃতির সেই রুদ্র রূপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জীবনযাত্রা চালিয়ে যায়। আবার শীতে যখন নদীর জল শান্ত ও স্বচ্ছ হয়ে ওঠে, তখন নদীর তীরে বসে গ্রামের যুবক-যুবতীরা গল্প করে, গান গায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা সাঙ্গু নদীর ধারে বসে তাদের ভালোবাসার স্বপ্ন বোনে।
এ গ্রামের অনেক প্রেমের গল্প সাঙ্গু নদীকে সাক্ষী রেখে গড়ে উঠেছে। স্থানীয় লোককথায় বলে, অনেক যুগ আগে এক তরুণ-তরুণীর ভালোবাসার সাক্ষী ছিল এই নদী। তারা প্রতিদিন নদীর ধারে দেখা করত, নদীর জলে প্রতিফলিত চাঁদের আলোকে ভালোবাসার প্রতীক মনে করত। একদিন কোনো কারণে তাদের বিচ্ছেদ হলে, সেই তরুণী নদীর ধারে বসে কেঁদেছিল, আর সাঙ্গু নদীর জল নাকি সেই কান্নার সুরে আরও গভীর হয়ে গিয়েছিল। আজও এই গল্প মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে।
শীলঘাটা গ্রাম এবং সাঙ্গু নদী পর্যটকদের জন্য এক আদর্শ স্থান। যারা প্রকৃতির নীরবতার মাঝে নিজেদের হারিয়ে ফেলতে চান, তাদের জন্য এটি এক স্বর্গরাজ্য। এখানে নৌকা ভ্রমণ, পাহাড়ের ঝর্ণা দর্শন, নদীর ধারে ক্যাম্পিং, এবং স্থানীয় আদিবাসীদের সংস্কৃতি উপভোগের সুযোগ রয়েছে।
বিশেষ করে পূর্ণিমার রাতে সাঙ্গু নদীর ধারে বসে নদীর ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে সময় কাটানোর অনুভূতি সত্যিই অপূর্ব। জ্যোৎস্না যখন নদীর জলে প্রতিফলিত হয়, তখন মনে হয় যেন আকাশ আর নদী একে অপরকে আলিঙ্গন করছে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা পর্যটকদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলতে ফারে।
শীলঘাটা গ্রাম এবং সাঙ্গু নদীকে রক্ষা করতে হলে পরিবেশ সংরক্ষণ জরুরি। অতিরিক্ত বালু উত্তোলন, বন উজাড়, এবং জলদূষণ যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে এই নদীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দাদের সমন্বয়ে নদী রক্ষায় পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এছাড়া, শীলঘাটা গ্রামে ইকো-ট্যুরিজম বিকাশের সুযোগ রয়েছে। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ অক্ষুণ্ণ রেখে পর্যটকদের জন্য নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তুললে, এটি স্থানীয় অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
সাঙ্গু নদী ও শীলঘাটা গ্রামের সম্পর্ক এক নিবিড় ভালোবাসার গল্প। প্রকৃতি ও মানুষের এই সহাবস্থান যদি সুরক্ষিত রাখা যায়, তবে এই নদী শুধু শীলঘাটার মানুষকেই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও তার স্নিগ্ধ ভালোবাসায় জড়িয়ে রাখবে।
শীলঘাটা গ্রামের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি বাঁধানো ঘাট, প্রতিটি ঢেউ যেন সাঙ্গু নদীর সঙ্গে তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের কথা বলে। এই সম্পর্ক শুধু জল ও ভূমির নয়, এই সম্পর্ক হৃদয়ের, ভালোবাসার, আর এক অবিচ্ছিন্ন বন্ধনের, যা যুগের পর যুগ বহমান থাকবে।
Leave a Reply